দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে দল থেকে বহিষ্কার করা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে বিএনপিতে। অভিযোগ উঠেছে, দলীয় কোন্দল আর প্রভাবশালীদের রোষানলে পড়ে পদ–পদবি হারাচ্ছেন অনেকে। কী কারণে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা কিংবা প্রমাণও দেওয়া হচ্ছে না তাদের। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে দলীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে বেশির ভাগ নেতাকর্মীকে অভিযোগের সত্যতা যাচাই–বাছাই ছাড়া বহিষ্কার করা হচ্ছে বলে দাবি তৃণমূল নেতাকর্মীর। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দীর্ঘ ১৭ বছর রাজপথের আন্দোলন, মামলা–হামলার পর ‘সুদিনেও ভাগ্য বিড়ম্বনায়’ পড়ছেন অনেক নেতাকর্মী।
তারা বলছেন, বহিষ্কারের নামে তাদের ‘রাজনৈতিক ক্রসফায়ার’ দেওয়া হচ্ছে। এতে একদিকে তারা রাজনীতিতে চিরস্থায়ী ক্ষতির মুখে পড়ছেন, অন্যদিকে পারিবারিক এবং সামাজিকভাবেও হেয়প্রতিপন্ন হচ্ছেন। কোনো একসময় দল তাদের বহিষ্কারাদেশ উঠিয়ে নিলেও যে ক্ষতিটা এখন হয়ে যাচ্ছে, তা আর পূরণ হবে না বলে জানান নেতাকর্মীরা।
অবশ্য বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, দেশের ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটলেও তাদের প্রেতাত্মারা রয়ে গেছে। তারা বিএনপির বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার শুরু করেছে ওই আন্দোলনকে কলুষিত করতে, বিএনপিকে বিতর্কিত করার জন্য। তবে তারা সচেতন আছেন, সজাগ আছেন। যারাই অপকর্ম করবে, তাদের বিরুদ্ধে দল ব্যবস্থা নেবে।
তৃণমূল নেতাকর্মীরা জানান, ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। এর আগে ওয়ান–ইলেভেন সরকারের আমল থেকে
ঘরবাড়ি ছাড়া বিএনপির বেশির ভাগ নেতাকর্মী। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর নির্যাতনের মাত্রা আরও শত গুণ বেড়ে যায়। ক্ষমতা থেকে পালিয়ে যাওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত মামলা–হামলা, গুম ও খুনের শিকার হতে হয় অনেককে।
বিগত দিনের হয়রানির বর্ণনা দিয়ে তারা বলেন, দলের এমন কোনো নেতাকর্মী নেই, যার বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। অনেকের চাকরি চলে গেছে, অনেকের ব্যবসা–বাণিজ্য দখল হয়েছে, অনেককে বাড়িঘর ছেড়ে দিতে হয়েছে। উদ্বাস্তুর মতো জীবনযাপন করেছেন কেউ কেউ। কর্মহীন জীবনে কেউ ঢাকা শহরে ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালিয়েছেন, কেউ বাসাবাড়ির কেয়ারটেকার, কেউ রিকশা চালিয়ে জীবন রক্ষা করেছেন। অন্যদিকে, দলের আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে আন্দোলন–সংগ্রামে সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করেছেন। আর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে যখন মনে করেছিলেন তাদের ‘সুদিন’ ফিরে এসেছে, একটু নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ হয়েছে, তখনই শুরু হয়েছে নানা অজুহাতে দলীয় শাস্তির খড়্গ। অনেকের বিষয়ে তথ্যপ্রমাণ সঠিক থাকলেও, অনেকের ন্যূনতম কোনো সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও নানা অপকর্মের তকমা লাগিয়ে বহিষ্কার করা হচ্ছে। এরই মধ্যে সারাদেশে প্রায় ১ হাজার নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে সিংহভাগ নিরপরাধ। বহিষ্কারের আগে ন্যূনতম কোনো তদন্ত করা হয়নি বলে তারা জানান।
নেতাকর্মীর অভিযোগ, প্রভাবশালী নেতাদের অনুগত না হলে, ভিন্ন গ্রুপের প্রতি সমর্থন থাকলে বেছে বেছে তাদের শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে। ওই সব নেতাকর্মীকে বেকায়দায় ফেলতে ভিন্ন কৌশল গ্রহণ করছেন সিন্ডিকেটের নেতারা। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে– দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগ তুলে সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ করা, এলাকার ভুয়া লোকদের স্বাক্ষরে অভিযোগ দাখিল করা। আর ক্ষমতাবান সিন্ডিকেট কোনো অভিযোগ না তুলেই বহিষ্কার করছে হরহামেশা। এতে আতঙ্ক বিরাজ করছে অনেক তৃণমূল নেতাকর্মীর মধ্যে।
যেসব বহিষ্কার নিয়ে নানা প্রশ্ন
এ রকম একটি ঘটনায় যুবদল ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাবেক সদস্য আজাদ চৌধুরী নাহিদ ও খিলগাঁও থানার ১ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সাবেক সদস্য সচিব আনোয়ার হোসেন অভিকে প্রাথমিক সদস্যপদসহ দল থেকে বহিষ্কার করেছে কেন্দ্রীয় যুবদল। তাদের বিরুদ্ধে কী অপরাধ, তা তারা নিজেরাও জানেন না। একটি পক্ষ তাদের বিরুদ্ধে একটি পত্রিকায় মনগড়া সংবাদ প্রকাশের জের ধরে কোনোরূপ আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে তড়িঘড়ি বহিষ্কার করা হয় বলে দাবি ওই দুই নেতার।
তারা বলেন, ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের পর গত ২৯ আগস্ট রাত ১২টার দিকে পশ্চিম নাখালপাড়া ছাপরা মসজিদ এলাকায় ওবায়দুল কাদেরের কথিত এপিএস নুরুল করিম জুয়েলের ছোট ভাই পাভেলের বাসায় অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সেখানে আওয়ামী লীগের কিছু শীর্ষ সন্ত্রাসী ও পাভেলের অবস্থানের তথ্যের ভিত্তিতে ছাত্র–জনতা এলাকাবাসীর উপস্থিতিতে এ অভিযান পরিচালিত হয়।
জনতার উপস্থিতি টের পেয়ে বাসায় অবস্থানরত পাভেল বাহিনীর সন্ত্রাসীরা তাৎক্ষণিক পালিয়ে যায়। তল্লাশিকালে সেখানে বিপুল সংখ্যক সরকারি পাসপোর্ট, ফাইল ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির পাসপোর্ট পাওয়া যায়। বাসার মধ্যে অলংকারের বেশ কিছু ফাঁকা বাক্স, খালি লাগেজ–ব্যাগ পাওয়া গেছে। এ সময় বাসার দারোয়ান সহযোগিতা করে এবং সব মালপত্র বাসার টেবিল ও রুমগুলোতে দারোয়ানের হেফাজতে রাখা হয়। এ ঘটনা যাতে ভিন্ন খাতে না নিতে পারে, সেজন্য সম্পূর্ণ ফুটেজ ধারণ করে রাখা হয় এবং মৌখিকভাবে তেজগাঁও থানাকে জানিয়ে দেওয়া হয়।
তবে ওই ভিডিওর স্থিরচিত্র তুলে ধরে একটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়, ‘প্রবাসীর বাসায় ডাকাতি করলেন যুবদল নেতারা!’ প্রতিবেদনে পাভেলকে শুধু একজন প্রবাসী উল্লেখ করা হলেও তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় গোপন করা হয়েছে। পাভেলের অপকর্মকেও আড়াল করা হয়েছে। পাভেলের বাসায় বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীর উপস্থিতিকেও এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। আর কেন্দ্রীয় যুবদলের নেতারাও কোনোরূপ যাচাই–বাছাই না করে শুধু ওই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে নিজ সংগঠনের নেতাদের ‘ডাকাত’ সাব্যস্ত করেই গত শুক্রবার মহানগর যুবদলের ওই দুই নেতাকে বহিষ্কার করে। যদিও ওই প্রতিবেদনের প্রতিবাদ প্রকাশের পাশাপাশি এর বিরুদ্ধে থানায় জিডি করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে পত্রিকাটির অনলাইন থেকে নিউজটি সরিয়ে নেওয়া হয় বলে জানা গেছে।
যুবদলের নেতাকর্মীরা জানান, কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে সখ্যকে পুঁজি করে সম্প্রতি এ ধরনের অনেক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ওই সব নেতাকর্মীর বিগত দিনের ত্যাগ, মেধা আর যোগ্যতা কিংবা নৈতিকতাকে আমলে নেওয়া হচ্ছে না।
গত শনিবার গাজীপুর মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব আ. হালিম মোল্লাকে শোকজ করে কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দল। এর আগে গত শুক্রবার তাঁর বিরুদ্ধেও একটি দৈনিক পত্রিকায় মনগড়া প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ১৯ আগস্ট গাজীপুর জেলার দক্ষিণ সালনার একটি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে হামলা ও সংঘর্ষে হালিম নেতৃত্ব দিয়েছেন। অথচ ওই দিন তিনি ঢাকায় বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মাজারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে। স্বেচ্ছাসেবক দলের ৪৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ছিল ওই দিন।
গাজীপুর স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীরা জানান, মহানগরের কিছু নেতা নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে শুধু হালিম নন, দলের আরও অনেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেছেন। এখানে হালিমকে সরিয়ে দিতে পারলে তাদের অনুসারী কাউকে ওই পদে নিয়ে আসতে পারবেন বলে মনে করছেন তারা।
আ. হালিম মোল্লা বলেন, গাজীপুর একটি শিল্পাঞ্চল হওয়ায় এবং এখানে অনেক ঝামেলা হতে পারে আশঙ্কায় তিনি নিজ এলাকায় রাজনীতি ছাড়া সবকিছু এড়িয়ে চলছেন। এখন সেই বদনামেরই ভাগীদার হতে হচ্ছে। এটা চরম বিব্রতকর বিষয়।
পিরোজপুর জেলায় চলছে কিছু নেতার রাজত্ব। যাকে যখন খুশি বহিষ্কার করা হচ্ছে, অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে। কোনো নিয়মকানুনের ধার ধরছেন না তারা। এরই মধ্যে জেলা যুবদলের আহ্বায়ক মারুফ হাসান, যুগ্ম আহ্বায়ক বদিউজ্জামান শেখ রুবেলকে বহিষ্কার করা হয়েছে কোনো অপরাধ ছাড়াই।
কেন্দ্রীয় যুবদলের একাধিক দায়িত্বশীল নেতা সমকালকে জানান, ওই দুই নেতার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ প্রমাণিত না হলেও একটি মহলের চাপে তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে। অথচ জেলা বিএনপিসহ জেলা যুবদলের সদস্য সচিব এমদাদুল হক মাসুম শেখের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় জমলেও কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছেন না তারা। শুধু সিন্ডিকেটের পছন্দ–অপছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে বেশ কয়েক জায়গায় নেতাকর্মীকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে বলে জানান খোদ যুবদলের কেন্দ্রীয় নেতারা। তবে কেন্দ্রেও সিন্ডিকেট থাকায় ভয়ে তারাও প্রকাশ্যে মুখ খুলতে নারাজ।
একইভাবে মাগুরা জেলা যুবদলেরও কয়েকজন নেতাকর্মীকে কোনো অপরাধ ছাড়াই বহিষ্কার করা হয়েছে বলে জানা গেছে। তাদের মূল অপরাধ– ওই সব নেতা বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরীর অনুসারী। রাজধানীর ধানমন্ডি থানা যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান হাবিবকেও ঠুনকো অজুহাতে বহিষ্কার করা হয়েছে।
এসব বিষয়ে বিএনপির এক প্রভাবশালী নেতা সমকালকে বলেন, ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি নিজ দলের বহু নেতাকে অপারেশন ‘ক্লিনহার্টে’র নামে ক্রসফায়ার দিয়েছিল। তখন মাঠের ত্যাগী আর সাহসী নেতারা বাড়িতে পর্যন্ত ঘুমাতে পারেননি। যার প্রভাব পড়েছে বিগত দিনে সরকারবিরোধী আন্দোলনে। এখন আবার বাস্তবতা না বুঝে, মাঠের ঘটনা না শুনে, না জেনে, তদন্ত না করে অন্যের ফাঁদে বহিষ্কারের ‘ক্রসফায়ার’ হচ্ছে। এতে দলটির ইমেজ ভিন্নভাবে চিত্রায়িত করার যে ‘গোপন এজেন্ডা’ চলছে, তাতেই তারা পা দিয়েছে।
শুধু অঙ্গসংগঠন নয়, মূল দল বিএনপিতেও চলছে প্রতিপক্ষের এজেন্ডা বাস্তবায়নে বহিষ্কারের খড়্গ। কোন্দলের কারণে অভিযোগ বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে গণমাধ্যমে সংবাদ হলে কোনো বাছবিচার করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে। এর মধ্যে সম্প্রতি ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ফখরুদ্দিন বাচ্চুকে বহিষ্কার এবং তাঁর বিরুদ্ধে দলের পক্ষ থেকে মামলা করা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তিনি দাবি করেন, এলাকায় শান্তি–শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এবং নৈরাজ্য থেকে সবাইকে নিবৃত রাখতে ব্যবসা করার জন্য দলের নেতাকর্মীর মধ্যে কাজ বণ্টন করার বিষয়ে সুপারিশ করেছিলেন। সেটাকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার জন্য একটি পক্ষ অপপ্রচার করে। আর এটাই তাঁর জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্থানীয় নেতাকর্মী জানান, শিল্পাঞ্চল হিসেবে পরিচিত এই এলাকায় বিএনপির অনেক নেতা সরাসরি অপকর্মে জড়িত থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে দল কোনো টুঁ শব্দটি করছে না। আর যিনি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে, শিল্পকারখানার নিরাপত্তা দিতে কাজ করেছেন, তাকেই বহিষ্কার করা হয়েছে।
সুত্রঃসমকাল