দেশে ফের চোখ রাঙাতে শুরু করেছে করোনাভাইরাস। নতুন রূপে ফিরেছে ওমিক্রনের উপধরণ। আইইডিসিআর সম্প্রতি বাংলাদেশে কভিড-১৯ পজিটিভ নমুনার জিনোম সিকোয়েন্সিং করে শক্তিশালী ওমিক্রন বিএ২.৮৬ ধরন পেয়েছে। গত মে মাসে সারাদেশে ১৩৪ জনের দেহে ভাইরাসটি শনাক্ত হয়েছে। মোট ১ হাজার ৪০৯ নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ৯ দশমিক ৫১, যা গত দুই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
২০২৩ সালের মে থেকে আগস্ট এবং ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সংক্রমণের হার ছিল ১ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) পরিচালিত কভিড-১৯ সার্ভিলেন্সের প্রাপ্ত উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাস সাধারণ জ্বর, সর্দি বা মৌসুমি ইনফ্লুয়েঞ্জার রূপ নিয়েছে। বহনকারীদের বেশির ভাগ পরীক্ষা করছেন না। ফলে সংক্রমণের সঠিক চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না। প্রকৃত করোনা রোগী অনেক বেশি ধারণা করা হচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ও টিকা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাদের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। সব বন্দরে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে দুটি হাসপাতাল প্রস্তুতের পাশাপাশি ফের টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গত ২৩ মে এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, করোনার নতুন ধরন এনবি.১.৮.১ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। ১৮ মে পর্যন্ত ২২ দেশে ৫১৮ জনের জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ে নতুন ধরন শনাক্ত হয়েছে।
আইইডিসিআর সম্প্রতি বাংলাদেশে কভিড-১৯ পজিটিভ নমুনার জিনোম সিকোয়েন্সিং করে শক্তিশালী ওমিক্রন বিএ২.৮৬ ধরন পেয়েছে। এটি আগেও বাংলাদেশে শনাক্ত হয়েছিল। তবে নতুন করে কতজন কোন ধরনে আক্রান্ত, তা উল্লেখ করেনি আইইডিসিআর। ভারতেও বর্তমানে এই ধরনের রোগী বাড়ছে।
আইইডিসিআরের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. আহমেদ নওশের আলম বলেন, ‘আক্রান্ত অধিকাংশের দেহে মিলেছে করোনার শক্তিশালী ধরন অমিক্রন বিএ২.৮৬। নতুন ধরন এক্সএফজির পাশাপাশি এক্সএফসিও পাওয়া গেছে। দুটিই অমিক্রনের জেএন-১ ভ্যারিয়েন্টের উপধরন।’
তিনি বলেন, ‘ভারতসহ বিভিন্ন দেশে করোনা রোগী বাড়ছে। আমাদের সচেতন হওয়া জরুরি। বিশেষ করে বয়স্ক মানুষ, অন্তঃসত্ত্বা ও দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্তদের। শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাদের কম, তাদের জন্য করোনা সব সময় ঝুঁকিপূর্ণ।’
দেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। এর ১০ দিন পর ১৮ মার্চ মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছর এখন পর্যন্ত ২ হাজার ৩৮৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ২১১ রোগী শনাক্ত হয়েছে। এ সময়ে মারা গেছে একজন। গতকাল মঙ্গলবার ১৩ জনসহ ১০ দিনে শনাক্ত হয়েছে ৫৭ রোগী। মে মাসে ৫০, এপ্রিলে ২৩, মার্চে ২৪, ফেব্রুয়ারিতে ২৭ ও জানুয়ারিতে শনাক্ত হয় ৩০ জন। দেশে এ পর্যন্ত মোট শনাক্ত দাঁড়িয়েছে ২০ লাখ ৫১ হাজার ৭৬০ জনে। মারা গেছে ২৯ হাজার ৫০০ জন। সুস্থ হয়েছেন ২০ লাখ ১৯ হাজার ৩৭৮ জন।
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, নতুন উপধরন দ্রুত ছড়ালেও গুরুতর অসুস্থতা বা মৃত্যুহার তেমন বাড়েনি। সতর্কতা হিসেবে নিয়মিত হাত ধোয়া, মাস্ক পরা ও টিকা গ্রহণে জোর দেন তিনি।
সব বন্দরে সতর্কতা
গত ৪ জুন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. হালিমুর রশিদের সই করা এক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ভারতের বিভিন্ন স্থানে নতুন করে করোনা সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সব নৌ, স্থল ও বিমানবন্দরে স্ক্রিনিংসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষা মানার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসা সন্দেহজনক যাত্রীদের স্থল, নৌ এবং বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন, আইএইচআর হেলথ ডেস্কের সহায়তার বিষয়ে স্বাস্থ্য বার্তা প্রদান ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিবিড়ভাবে পরিচালনার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে নির্দেশনায়।
মাস্ক ব্যবহারে গুরুত্ব আরোপ
সংক্রমণ হার বিবেচনায় নিয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় জনসমাগমপূর্ণ এলাকায় মাস্ক পরার পরামর্শ দিয়েছে। একই সঙ্গে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ে পৃথক বিজ্ঞপ্তিতে যাত্রীদের মাস্ক ব্যবহারের অনুরোধ জানিয়েছে। স্বাস্থ্য বাতায়নের ১৬২৬৩ নম্বরে করোনাবিষয়ক কলের সংখ্যা হঠাৎ করে বেড়ে গেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
টিকাদানের পরামর্শ
গত ২২ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক সভায় উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীকে করোনার টিকা দেওয়ার পরামর্শ উঠে আসে। পরে এ-সংক্রান্ত চিঠি সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো হয়। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) তথ্য বলছে, সরকারের হাতে বর্তমানে ৩১ লাখ ফাইজারের করোনা টিকা রয়েছে। গত দুই মাসে ১৭ লাখ ১৬ হাজার ৯০০ ডোজ ফাইজারের টিকা জেলাগুলোয় পাঠানো হয়, যার মেয়াদ শেষ হবে আগামী ৬ আগস্ট।
পরিস্থিতি বিবেচনা করে ব্যবস্থা
ডা. হালিমুর রশিদ বলেছেন, কিছু জায়গায় করোনা কিটের সংকট রয়েছে। এ জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় কিট কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি কেন্দ্রীয় ঔষধাগার কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। পর্যবেক্ষণ করে পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী সায়েদুর রহমান জানান, কভিড পরিস্থিতি মোকাবিলায় তারা সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিচ্ছেন। টেস্টিং কিট সংগ্রহ করা হচ্ছে। কোনো অঞ্চলেই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। তবে পার্শ্ববর্তী দেশে রোগী বৃদ্ধি পাওয়ায় জনগণকে সতর্ক করা হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, নতুন ধরনের জন্য আলাদা টিকা নেই। পুরোনো টিকাই ফের দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। ঢাকায় ডিএনসিসি কভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল এবং চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউ প্রস্তুত করা হচ্ছে। টেস্টিং ল্যাবগুলো সচলের কাজও শুরু হয়েছে।