গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশে সরকার পতনের দিনে ঢাকার যাত্রাবাড়ী থানার সামনে পুলিশের গুলি থেকে প্রাণে বাঁচতে হামাগুড়ি দিয়ে পালিয়েছিলেন কলেজছাত্র সুফি আহম্মেদ। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী ক্ষতিগ্রস্ত সেই থানা বন্ধুদের সঙ্গে দলবেঁধে পাহারা দিচ্ছেন ওই ছাত্র।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল একটি ভিডিও দেখিয়ে সুফী নিজেকে চিহ্নিত করে বলেন সাদা টিশার্ট কালো প্যান্ট পরা যে তরুণ হামাগুড়ি দিচ্ছে সেটি তিনি। পায়ে ছররা গুলি লেগেছিল তার।
তিনি বলেন, ওখানে পুলিশ একাধারে গুলি করছিল। খুবই ভয়াবহ একটা অবস্থা ছিল। মারা যাওয়ার অবস্থায় ছিলাম। অনেকে ভাবছে যে আমি মারা গেছি। আমার পাশেই একজন মারা যায়।
যাত্রাবাড়ী থানায় এখনো কোনো পুলিশ নেই। ৫ আগস্ট বিকালে যাত্রাবাড়ী থানা জ্বালিয়ে দেয় ক্ষুব্ধ ছাত্র জনতা। ওইদিন অন্তত ছয়জন পুলিশ সদস্য নিহত হন। ছাত্র আন্দোলন সহিংস হবার পর ঢাকার যাত্রাবাড়ীতেই সবচেয়ে বেশি আন্দোলনকারী এবং পুলিশ মারা যাবার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
সুফী আহম্মেদ দাবি করেন পুলিশ না থাকায় এলাকার চাঁদাবাজি, ছিনতাই বন্ধে তারা কাজ করছেন। স্থানীয় ছাত্র-তরুণরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে থানা-কেন্দ্রিক বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করছেন। পুলিশ আমাদের সঙ্গে কার্যক্রম চালাতে চাচ্ছে। আমরা ছোটভাই এবং সিনিয়র মিলে ৩০-৩৫ জনের মতো আছি একটা টিম গঠন করে। আমরা মূলত পুলিশের কার্যক্রম চালাচ্ছি।
ছাত্র আন্দোলন যাত্রাবাড়ীর এই সুফীর গল্পটি বাংলাদেশে অভ্যুত্থান পূর্ব ও পরবর্তী পুলিশের বিপরীতমুখী দুটি অবস্থার চিত্র সামনে আনছে।
ছাত্র আন্দোলনে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নির্বিচারে গুলিতে সাড়ে ছয়শর বেশি নিরস্ত্র মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সরকার থেকে এখনো পূর্ণাঙ্গ সংখ্যা দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে বিগত সরকার পতনের পর বাংলাদেশে সাড়ে চারশর মতো থানা পুলিশ ফাঁড়ি হামলা ও অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর করা হয়েছে।
সরকারি হিসেবে ৪৪জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। এখনো পুলিশ কাজে ফিরলেও মানসিকভাবে মারাত্মক হীনমন্য অবস্থা এবং এক ধরনের ভীতির মধ্যে দিয়ে কাজ করছে।
সমালোচনা রয়েছে বাংলাদেশে অতীতে সব রাজনৈতিক দল পুলিশকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। বিগত দেড় দশকে আওয়ামী লীগ আমলে পুলিশ নিয়ে সাধারণ মানুষের অভিযোগ ছিল সর্বাধিক।
ভবিষ্যতে পুলিশকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের লাঠিয়াল বাহিনীর মতো কেউ যেন ব্যবহার করতে না পারে সেজন্য পুলিশ সংস্কারের জোরালো দাবি উঠেছে।
ছাত্র নেতাদের অভিজ্ঞতা: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক আরিফ সোহেল আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে গ্রেফতার ও রিমান্ডের মুখে পড়েন। তিনি বলেন, স্থানীয় জনগণকে নিয়ে যাতে পুলিশিং করতে পারে এটা নিশ্চিত করতে হবে।
তার ভাষায়, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কাঠামো থাকে বেরিয়ে এসে নতুন একটা কাঠামো দরকার যেটা আসলে জনগণকে সেবার জন্য তৈরি করা হবে।
তিনি বলেন, আমরা মনে করি পুলিশ কাঠামো একেবারে গোড়া থেকে উপড়ে নতুন করে তৈরি করতে হবে। পুলিশ কোড থেকে শুরু করে তার ফাংশন করার যে পদ্ধতি তার সেন্ট্রালাইজ যে স্ট্রাকচার সবকিছু ভেঙে ফেলে স্থানীয়ভাবে পুলিশকে ক্ষমতায়ন করতে হবে। দ্বিতীয় যে জায়গাটা আমরা জোর দিতে চাই সেটা হলো পুলিশের আচরণ। যারা পুলিশের কাছে আটক হবে তাদের সঙ্গে আচরণ, মানবাধিকার এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্র আন্দোলন চলাকালে আরিফ সোহেলকে ২৮ জুলাই গ্রেফতার হন। এরপর ৪৮ ঘণ্টার মতো তার কোনো খবর পায়নি পরিবার। আটক ও রিমান্ডের অভিজ্ঞতা থেকে আরিফ মনে করেন জেল হাজতগুলো আসামি বা যাদেরকে গ্রেফতার করা হবে তাদের জন্য সহনশীল ও মানবিক হতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সেখানে যাতে খাবার দাবার, বস্ত্র এবং ঘুমানোর জায়গা সবকিছু মানুষ যেভাবে থাকে সেইরকম হয় পশুপাখি রাখার মতো, যেটা বর্তমানে আমি দেখে এসেছি এরকমটা যাতে না থাকে এটা নিশ্চিত করতে হবে।
ছাত্র আন্দোলনের সময়কার পুলিশের আচরণের সমালোচনা করে আরিফ বলেন, সেই জায়গাতে আমার যে অভিজ্ঞতা আমি যা যা দেখেছি। যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে মানুষকে অত্যাচার করা হচ্ছে, টর্চার করা হচ্ছে। সেখানে জিজ্ঞাসাবাদের নামে মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে। এই যে ব্যাপারগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করে যে পুলিশিং সিস্টেম এটা অবশ্যই সংস্কার করতে হবে। আমরা মনে করছি কলোনিয়াল স্ট্রাকচারটা ভেঙে ফেলে আমাদেরকে সম্পূর্ণ নতুন করে নতুন পুলিশ কোড এবং নতুন পুলিশিং ব্যবস্থা স্থাপন করতে হবে। এটা আমাদের আশা এবং আকাঙ্খা।
পুলিশের কার্যক্রমে স্বচ্ছতার দাবি: ছাত্র আন্দোলনে সমন্বয়কদের অনেকে গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি নামে একটি ২০২৩ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি সংগঠনের সদস্য।
ছাত্রশক্তির আহ্বায়ক আখতার হোসেন ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আটক হন। এর আগেও দুইবার তাকে গ্রেফতার করা হয়। আখতার বলছিলেন, পুলিশের আচরণ থেকে মামলা, গ্রেফতার, রিমান্ড পদ্ধতি সবখানে সংস্কার প্রয়োজন। পুলিশ রিমান্ডের নামে যেভাবে অত্যাচার করে সেটা অত্যন্ত অমানবিক। আমাকে এমনভাবে টর্চার করা হয়েছিল যে আমি দুই-তিন সপ্তাহ হাটু ফেলে নামাজ পড়তে পারিনি। এই টর্চারগুলো থেকে পুলিশকে বেরিয়ে আসতে হবে।
নিজ অভিজ্ঞতা থেকে আখতার বলেন, দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো গ্রেফতার করার পরে পুলিশ কোনোভাবেই আর পরিবারকে জানাতে দেয় না। ২০২১ সালে আমি যখন ডিবির গারদে সেখানে কয়েকজন ব্যক্তিকে দেখেছি মামলা ছাড়াই তাদের চার-পাঁচদিন ধরে সেই গারদে আটকে আছেন, এবং সেটা তাদের পরিবারও জানেন না। এই জিনিসটা কিন্তু আমাদের পরিবারগুলোকে চূড়ান্ত হয়রানি এবং অসহায়ত্বের ভেতর দিয়ে নিয়ে যায়। গোপনীয় যে সেলগুলো আছে সেগুলো প্রকাশ্যে নিয়ে আসা দরকার। কোনো গোপন কার্যক্রম চলবে না। পুলিশ বাহিনী স্বচ্ছতার মাধ্যমে চলবে। এবং কোনো আন্ডার মিশন থাকবে না। যা কার্যক্রম সবকিছু পরিস্কার হবে, স্বচ্ছ হবে, ডকুমেন্টেড থাকতে হবে।
আখতার হোসেন বলেন, গত ১৬ বছর ধরে পুলিশ এমনভাবে একদলীয়করণ হয়ে গেছে যে এটা আর আলাদা করে কোনো রাষ্ট্রীয় বাহিনী হিসেবে এক্সিস্ট করে না। মানুষের কাছে পুলিশের মেসেজটা ছিল এমন যে পুলিশ লীগ।
আমরা দেখেছি সবশেষ ছাত্র আন্দোলনে পুলিশ কী নগ্নভাবে নৃশংসভাবে ছাত্র জনতার ওপর নিপীড়ন করেছে। শুধু গুলি করা না, মানুষ মারা গেছে সেই মরদেহের সঙ্গে যে আচরণ সেটাও কোনো মানবিক কোনো ট্রিটমেন্ট ছিল না। এই বিষয়গুলো পুলিশকে জনসাধারণের কাছ থেকে দারুণভাবে পৃথক করে ফেলেছে। এমতাবস্থায় পুলিশ বাহিনীতে একেবারে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত রিশাফলিং দরকার।
আলোচনায় পুলিশ কমিশন: পুলিশ সংস্কারের অংশ হিসেবে একটি স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের কথা বলা হচ্ছে। জনবান্ধব রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পুলিশ বাহিনী গঠনের লক্ষ্যে ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে একটি পুলিশ সংস্কারের প্রস্তাব নিয়ে অনেক কাজ হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সরকার সেটি বাস্তবায়ন করেনি।
বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরেও পুলিশ কমিশন গঠনের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। তবে পুলিশ সংস্কার এবং পুলিশ সার্ভিস নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণায় যুক্ত অধ্যাপক ওমর ফারুক বলেন, শুধু পুলিশ কমিশন করলে সবকিছু সমাধান হবে না।
তিনি বলেন, পলিটিসাইজেশন থেকে যদি আপনি বিযুক্ত করতে না পারেন তাহলে কমিশন কাজ করবে না। আমাদের দেশে কিন্তু নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন মানবাধিকার কমিশন আছে এদের ভূমিকাটা কী? মৌলিক পরিবর্তন যদি আপনি না করেন শুধু সংস্কার দিয়ে দুইটা একটা আইন বা এমেন্ডমেন্ট করে সংস্কার করলে পরিপূর্ণতা পাবে না।
ওমর ফারুক বলেন, বাংলাদেশে ডেমোক্রেটিক পুলিশিংটা যদি হয় তাহলে এটা জনগণের প্রকৃত প্রত্যাশা আছে সেটি যথাযথ পূরণ হবে। এবং ডেমোক্রেটিক পুলিশের যে মৌলিক নীতিগুলো আছে মানুষের ডিগনিটি, রেসপেক্ট তারপরে লিগ্যাল একসেসগুলি, তার কোড অব কনডাক্ট কী হবে, পুলিশের অ্যাকশন কী হবে এবং প্রত্যেক মামলার আউটকাম ভিকটিমকে জানানো জনগণকে জানানো সেই জায়গাগুলি কিন্তু করতে হবে।
অন্তবর্তী সরকারের উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান পয়লা সেপ্টেম্বর সাংবাদিকদের পুলিশ সংস্কার নিয়ে বলেন, জাতিসংঘের সুপারিশসহ সবার মতামতের ভিত্তিতেই পুলিশ সংস্কার হবে। পুলিশ হয় এই দলকে দিয়ে ব্যবহৃত হয়েছে নয় ওই দলকে দিয়ে ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশ আর তাদেরকে হয়ে ওঠা হয়নি। পুলিশের মধ্যেও কিন্তু পরিবর্তনের বিশাল একটা তাড়া আছে।
যদিও পুলিশ সংস্কার বিষয়ে মূল কাজ করবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে বর্তমানে ওই মন্ত্রণালয় কীভাবে এগুচ্ছে এবং কী করছে সে বিষয়ে সচিবালয়ে গিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে জানতে চাইলেও তিনি সাক্ষাৎকার দিতে রাজী হননি।–বিবিসি