বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভের সময় নিরাপত্তা বাহিনী অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, পুলিশ বেশ কাছ থেকে কোন কোন বিক্ষোভকারীর দেহে একাধিক গুলি করেছে।
যখন গুলি করা হচ্ছিল তখন বিক্ষোভকারীদের হাতে কোন প্রাণঘাতী অস্ত্র ছিলনা।
পুলিশের গুলি করার বেশ কয়েকটি ভিডিও ‘বিবিসি ভেরিফাই’ যাচাই করে সেগুলোর সত্যতা পেয়েছে।
এদিকে, সামাজিক মাধ্যমে পাওয়া তিনটি ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণের ভিত্তিতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “প্রতিবাদ দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রাণঘাতী ও মৃদু প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার করেছে”।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সিনিয়র ডিরেক্টর ডেপ্রোজ মুচেনা বলেন, “বাংলাদেশ থেকে আসা ভিডিও এবং ছবির ক্রমাগত যাচাই ও বিশ্লেষণে সেখানকার এক ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।”
বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার কাছে, নিরাপত্তা বাহিনীর গুলি করার যেসব তথ্য-প্রমাণ রয়েছে সেগুলোর মাধ্যমে তারা কী করতে পারে?
এর মাধ্যমে কি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব?
কী ধরণের প্রমাণ আছে?
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, বাংলাদেশে ছাত্র বিক্ষোভের সময় নিরাপত্তা বাহিনী যে অন্যায়ভাবে শক্তি প্রয়োগ করেছে সেগুলোর প্রমাণ রয়েছে সংস্থাটির কাছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছে, বাংলাদেশ থেকে তারা যেসব ভিডিও এবং ছবি পেয়েছে সেগুলোকে তারা যাচাই ও বিশ্লেষন করছে। এর মাধ্যমে উদ্বেগজনক চিত্র বের হয়ে আসছে বলে তারা উল্লেখ করেছে।
“বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি, আবদ্ধ জায়গায় শিক্ষার্থীদের ওপর বিপজ্জনক টিয়ার শেল নিক্ষেপ করা হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনী একে-৪৭ ধরণের রাইফেল, প্রাণঘাতী অস্ত্রের যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে।”
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এসবের প্রমাণ পেয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
সংস্থাটি বলছে, “পুলিশের প্রতি কোন হুমকির কারণ ছিলনা, এমন ব্যক্তিদেরও ওপর ইচ্ছাকৃত এবং অযৌক্তিক আক্রমণ করা হয়েছে।”
“বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে যেভাবে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে এটি প্রতীয়মান হয় যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো মানুষের জীবনের প্রতি চরম উদাসীন ও অবমাননাকর আচরণ করেছে এবং তারা মানবাধিকার আইনের কোন তোয়াক্কা করেনি।”
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছে, মানবাধিকার সংগঠনগুলো এসব তথ্য-প্রমাণের সাহায্যে স্বাধীন তদন্ত করার জন্য সমর্থন জোগাড় করতে পারে।
সংকটের সময় এসব তথ্য-প্রমাণ সংরক্ষণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসব তথ্য-প্রমাণ ভবিষ্যতে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিচার চাওয়ার সুযোগ আছে?
জাতিসংঘ নিয়োজিত মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ এবং নরওয়ের ইউনিভার্সিটি অব অসলোর আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাপক সিসিলিয়া এম বাইয়ে বিবিসি বাংলাকে বলেন, যে কোন দেশে মানবাধিকার লংঘণের তথ্য-প্রমাণ জাতিসংঘের আওতায় মানবাধিকার সংক্রান্ত যেসব মেকানিজম আছে সেখানে তুলে ধরতে পারে।
তিনি বলেছেন, “এর মধ্যে একটি হচ্ছে, আমি যেখানে কাজ করি সেখানে। আমাদের কাছে তারা এসব তথ্য-প্রমাণ দিতে পারে। এরপর আমরা সংশ্লিস্ট সরকারকে বিষয়টি জিজ্ঞেস করতে পারি এবং তাদের ব্যাখ্যা চাইতে পারি।”
“আপনি হয়তো দেখেছেন, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার খুবই শক্ত একটি বিবৃতি দিয়েছেন। এর অর্থ হচ্ছে, জাতিসংঘ বিষয়টিতে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। এ ধরণের তথ্য-প্রমাণ সত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন অধ্যাপক বাইয়ে।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে বিভিন্ন বিবৃতি দিয়েছে।
এবারের ছাত্র বিক্ষোভ ও সহিংসতার পরেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। প্রশ্ন হচ্ছে, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কি কোন পদক্ষেপ নিতে পারে? নাকি শুধু বক্তব্য বিবৃতির মধ্যেই তারা সীমাবদ্ধ থাকবে?
অধ্যাপক বাইয়ে বলেন, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় যে কোন দেশের সার্বভৌমত্ব এবং স্থিতিশিলতা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ কারণে মানবাধিকারের বিষয়টি ‘খুব ভঙ্গুর’ অবস্থায় চলে যায়।
তিনি বলেন, “বিভিন্ন দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে গিয়ে মানবাধিকারের বিষয়টিকে খুবই সংবেদনশীলতার সাথে বিবেচনা করতে হয়। এজন্য মানবাধিকার রক্ষার শক্তি দেশের ভেতর থেকে তৈরি হতে হয়, এটা জণগণের ভেতর থেকে আসতে হয়। এটা উপর থেকে কিংবা বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়া যায়না।”
এজন্য, বিভিন্ন সংস্থা তথ্য-উপাত্ত জোগাড় করার মাধ্যমে সত্য ঘটনা তুলে ধরছে। মাঠে কী ঘটেছে সেগুলো জণগণের সামনে তুলে ধরছে বিভিন্ন সংস্থা।
যেসব তথ্য-প্রমাণ আছে মানবাধিকার সংস্থগুলোর কাছে এর মাধ্যমে কি দোষীদের আন্তর্জাতিকভাবে বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব?
অধ্যাপক বাইয়ে বলেন, “আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মখোমুখি করার আগে দেখতে হবে, দেশের বিচার ব্যবস্থার ভেতরে প্রতিকার চাওয়া হয়েছে কী না। আন্তর্জাতিক বিচারে যাবার আগে দেশের ভেতরে সবগুলো ব্যবস্থা দেখতে হবে।”
অনেকে মনে করেন, দেশের ভেতরে ন্যায় বিচার পাওয়া সম্ভব নয়। সেজন্য আন্তর্জাতিক সংস্থার দ্বারস্থ হতে তারা পছন্দ করেন। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আদালতে বিচার পাবার সুযোগ যে নেই তা নয়।
অধ্যাপক সিসিলিয়া এম বাইয়ে বলেন, সেক্ষেত্রে দেশের বিচার বিভাগ যে বিষয়টিতে দৃষ্টি দিচ্ছে না – সে প্রমাণ দিতে হবে। এ বিষয়টি আন্তর্জাতিক বিচার ব্যবস্থার সামনে তথ্য-প্রমাণ দিয়ে হাজির করতে হবে।
“ঘটনাগুলো কোন সময় থেকে কোন সময়ের মধ্যে ঘটেছে এবং এক্ষেত্রে দেশের ভেতরে কোন ধরণের প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়েছিল, বিচার বিভাগের বিভিন্ন স্তরে প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল সেগুলো মূল্যায়ন করা হবে।
“এরপর যদি দেখা যায় যে দেশের ভেতরে কার্যকর ব্যবস্থা নেবার ক্ষেত্রে ঘাটিতি ছিল,তাহলে সেক্ষেত্রে এসব প্রমাণ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উত্থাপন করা যায়। তখন আন্তর্জাতিক বিচার ব্যবস্থা নিশ্চয়ই সেটি বিবেচনায় নেবে।”
তিনি বলেন, তরুণরা মনে করে, মানবাধিকারের বিষয়টি হারিয়ে যেতে পারে না। বিশ্বজুড়ে তরুণেরা বলছে- মানবাধিকারের প্রয়োজন আছে। তারা বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলছে।
যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো ল’ স্কুলের অধ্যাপক এরিক পসনার গার্ডিয়ান পত্রিকায় ‘দ্য কেইস এগেইনস্ট হিউম্যান রাইটস’ শীর্ষক এক নিবন্ধে লিখেছেন, মানবাধিকার সংক্রান্ত যেসব আন্তর্জাতিক আইন আছে, সেগুলো বেশ অস্পষ্ট।
জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল-এর মতো যেসব আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আছে সেখানে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের অভাব আছে।
মানবাধিকার মেনে চলার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যাতে বাধ্য করতে না পারে – সেজন্য সদস্য দেশগুলো এসব সংস্থাকে শক্তিশালী করতে চায়না।
অধ্যাপক পসনার বলেন, মানবাধিকার সংক্রান্ত আইন ও সংস্থাগুলো নিপিড়ীত মানুষকে নৈতিক সহায়তা দেয় মাত্র, তাদের কোন বিচার করার ক্ষমতা নেই।
তিনি লিখেছেন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো বেসরকারি সংস্থাগুলো মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নতি করার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে পারে।
যদিও তারা দেশগুলোকে বাধ্য করতে পারে না।
সরকার কী বলছে?
বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী যেভাবে বিক্ষোভ দমনের ক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগ করেছে সেটি নিয়ে ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা সরকারের সমালোচনা করেছে।
বুধবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সাথে আলাদা আলাদা বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো নিয়ে জাতিসংঘ প্রতিনিধি বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীদের কাছে জানতে চেয়েছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জাতিসংঘ প্রতিনিধিকে জানিয়েছেন, পুলিশ এবং নিরাপত্তা বাহিনী ইচ্ছে করে গুলি করেনি। জনগণের ‘জীবন এবং সম্পদ বাঁচানোর জন্য’ তারা গুলি করতে বাধ্য হয়েছে।
“এই যে এতাগুলো মানুষ হতাহত হলো, শুধু কি পুলিশের গুলিতে হয়েছে? আপনার খোঁজ নিয়ে দেখুন, আমরাও প্রকাশ করবো কার গুলিতে কতজন নিহত হয়েছে,” বুধবার সাংবাদিকদের বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
তিনি বলেছেন, “পুলিশ অনেক ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে। শিশু-কিশোরদের সম্মুখে আনা হয়েছিল। যারা আসল ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা ছিল শিশুদের পিছনের লাইনে।”
“তারা (জাতিসংঘ) অনেক কিছুই জিজ্ঞেস করেছে। দুই-একজন কিশোরের কথা জানতে চেয়েছিল, কয়েকজন কিশোর নিহত হয়েছে।”
“আমরা একটা কিশোরের কথা বললাম। সে জঘন্য অন্যায় কাজ করেছে। যাত্রাবাড়ীতে পুলিশ হত্যাকাণ্ডের সাথে সে জড়িত ছিল। সে তো পুলিশ হত্যা করেছেই, এবং পুলিশকে ঝুলিয়ে রাখার জন্য দড়ি টানতেছিল,” বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
“এই কিশোরকে আমরা কোথায় নেব? তার কাছে আমরা প্রশ্ন করেছিলাম। বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে কিশোর সংশোধনাগারে আমরা রেখেছি তাকে,” বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
সরকার আশঙ্কা করছে, সামনের দিনগুলোতে আন্তর্জাতিক মহলে তাদের আরো প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনার ফলকার তুর্ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যে চিঠি দিয়েছেন, তার জবাব দিয়েছে সরকার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে এই চিঠির জবাব দেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন।
চিঠিতে আন্দোলনে সহিংসতার জন্য বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করা হয়েছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে নিহতের সংখ্যা অন্তত ২০৮ জন বলা হলেও, বাংলাদেশ সরকারের চিঠিতে বলা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১৪৭ জন নিহত হবার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়, “ছাত্রদের বিক্ষোভ শুরুতে শান্তিপূর্ণ ছিল। কিন্তু সেখানে ‘তৃতীয় পক্ষ’ ঢুকে যাওয়ার পর বিষয়টি সহিংসতার দিকে গড়ায় এবং আন্দোলনের নেতৃত্ব শিক্ষার্থীদের হাত থেকে বেরিয়ে যায়।”
সহিংসতার ঘটনা নিয়ে তদন্ত হচ্ছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
পররাষ্ট্র সচিব বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে যাতে গুজব এবং মিথ্যা তথ্য না যায়, সেজন্য বিদেশে বাংলাদেশি মিশনগুলোকে সজাগ থাকতে বলা হয়েছে।
“মৃত্যুর ঘটনাগুলো তদন্ত সাপেক্ষে তারাও হয়তো সামনে আমাদের ওপর তাদের যে টুলসগুলো আছে সেগুলো ব্যবহার করার চেষ্টা করবে। এটাই স্বাভাবিক,” বলেন মাসুদ বিন মোমেন।
“একটা ভুল তথ্য ঘটছিল যে র্যাব হেলিকপ্টার থেকে গুলি করেছে। কিন্তু আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে র্যাব হেলিকপ্টার থেকে কোন গুলি করেনি।”
এ বিষয়ে ‘ভিডিও এভিডেন্স’ আছে বলে উল্লেখ করেন পররাষ্ট্র সচিব এবং এসব প্রমাণ কূটনীতিকদের কাছে দেয়া হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
বিবিসি বাংলা