বিএনপির রাজনীতি করে আগের মতো জোশ পাচ্ছেন না নেতাকর্মী। কেন্দ্রীয় নেতাদের ইশারায় অদক্ষ ও দুর্বল নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত হয় কমিটি। নিষ্ক্রিয়রা কমিটিতে নাম লিখিয়ে ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীকে করে ফেলেন ‘বোতলবন্দি’। এমন অবমূল্যায়নে দলের অনেকেই হতাশ ও ক্ষুব্ধ।
১৩ সাংগঠনিক মহানগর কমিটির সবকটিই এখন মেয়াদহীন। ফলে সরকারবিরোধী আন্দোলনে আগেই ফেল মেরেছেন মহানগরের নেতারা। দায়িত্বশীল নেতাদের অকার্যকর ভূমিকা, কর্মীর পাশে না দাঁড়ানো এবং সমন্বয়হীনতায় জাতীয় নির্বাচনের পর দলে বড় ধরনের তালগোল পেকেছে। পাশাপাশি মামলা-হামলা মোকাবিলা করতে করতে একরকম ‘কুপোকাত’ দলটির কর্মীরা। এর মধ্যেই দলটির ঘরোয়া বিবাদ আরও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে গেছে। অভিযোগ আছে, এ দলাদলিতে আশকারা দিচ্ছেন খোদ কেন্দ্রীয় নেতারাই।
নেতাকর্মী জানান, কারাবন্দি হওয়ার পর তাদের মামলা পরিচালনা থেকে শুরু করে চিকিৎসা, কারাগারের খরচ– সবকিছু বহন করতে হয়েছে পরিবারকে।
এতে ত্যক্ত-বিরক্ত অনেকে রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়েছেন। রাজনীতি করে আর ‘রাজা’ হতে চাইছেন না তারা। অন্যদিকে, বিএনপির অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ সামনে রেখে অনেক হতাশ কর্মী নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেছেন। অনেকে নিজের ব্যক্তিগত আর কর্মজীবনকে প্রাধান্য দিতে শুরু করেছেন।
এমন হযবরল পরিস্থিতির মধ্যেও ঘুরে দাঁড়ানোর কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকার চেষ্টা করছে বিএনপি। এই যেমন– গেল রোজার মাসে প্রতিদিনই কোনো না কোনো এলাকায় ইফতার মাহফিল করে সাধারণ নেতাকর্মীকে চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করেছে। তবে তাতেও খুব একটা কাজ হয়নি। কোনোভাবেই আগের মতো কর্মসূচি জমাতে পারেনি দলটি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত দু’বছরের ধারাবাহিক কর্মসূচিতে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা মহানগরের সক্ষমতার জানান দিলেও সর্বশেষ আড়াই মাসের চূড়ান্ত আন্দোলনে এর প্রতিফলন ছিল না। দুই মহানগরে টার্গেট করে সক্রিয় আর যোগ্যদের কারাবন্দি করার পর হাল ছেড়ে দিয়েছেন অন্যরা। বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে দলে ত্রিমুখী বলয় আর নেতারা আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় ‘হাল’ ছেড়ে দিয়েছেন তৃণমূল কর্মীরা। সবচেয়ে বেশি মামলা আর কারা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন খুলনা মহানগরের নেতারা। আবার বিভক্তি, ফটোসেশন আর সমন্বয়হীনতা বেশি ছিল বরিশাল মহানগরে।
রাজশাহী মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের নামে কোনো মামলা নেই, কখনও হাতকড়াও পরতে হয়নি তাদের। দুর্বল নেতৃত্বের কারণে এখানে কখনোই আন্দোলন দানা বাঁধেনি। সিলেটে শুরুতে ছিল সমন্বয়হীনতা। আন্দোলন শুরুর পরপরই নেতারা চলে যান আত্মগোপনে। ফলে তৃণমূল নেতাকর্মী ছিলেন নির্দেশনার বাইরে। রংপুরেও শীর্ষ নেতারা ছিলেন আড়ালে। কোন্দলের কারণে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়নি।
সূত্র জানায়, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে পরিচয়দানকারী আবদুর রহমান সানির পছন্দের কমিটিতে অযোগ্যরা স্থান পেয়েছেন কুমিল্লায়। ফলে আন্দোলন করতে হয়নি তাদের। এ জন্য কোথাও কোনো কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে না ক্ষমতার আশীর্বাদপুষ্ট নেতাদের। ময়মনসিংহে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টাই ছিল না। একই অবস্থা গাজীপুরেও। সেখানে নেতাকর্মীকে সংগঠিত করে জোরালো আন্দোলনের কোনো আগ্রহ ছিল না নেতাদের। অবশ্য সাধ্যমতো আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন নারায়ণগঞ্জের নেতারা।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সমকালকে বলেন, বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল। দলে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা আছে, কোনো কোন্দল নেই। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে হামলা-মামলা মোকাবিলায় নেতাকর্মী আজ সর্বস্বান্ত। তবু তারা ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন।
ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ
ঢাকা মহানগরের দুটি কমিটি গঠন করা হয় ২০২১ সালের ২ সেপ্টেম্বর। অবশ্য আন্দোলনে কাঙ্ক্ষিত সফলতা দেখাতে পারেনি কমিটি। সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান, সদস্য সচিব আমিনুল হক; ঢাকা দক্ষিণের সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনু, ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব তানভীর আহমেদ রবীনসহ সংগঠনের সক্রিয়, সাংগঠনিক আর সাহসী নেতাকর্মীকে কারান্তরীণের পর বেশির ভাগই ছিলেন আত্মগোপনে।
বিএনপি নেতাকর্মীর অভিযোগ, নির্বাচনের আগে শেষ আড়াই মাসের আন্দোলনে তৃণমূল নেতাকর্মী এ দুই কমিটির বেশির ভাগ দায়িত্বশীল নেতাকে কাছে পাননি। এমনকি ফোনেও পাওয়া যায়নি। মহানগর উত্তরের আমিনুল হককে গ্রেপ্তারের পর ওই এলাকায় আন্দোলনে ভাটা পড়ে। দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালাম আন্দোলনের শুরু থেকেই ছিলেন আত্মগোপনে। শুরুতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেও তাঁকে খুঁজে পাননি বলে বিএনপির বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা জানান। ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব লিটন মাহমুদ ছিলেন মূল ভূমিকায়।
মহানগর উত্তরের সদস্য সচিব আমিনুল হক জানান, বিএনপি নেতাকর্মীরা এত অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেও দেশের জনগণের জন্য রাজপথে লড়াই করছেন। তাদের মধ্যে মোটেও হতাশা কাজ করছে না।
চট্টগ্রাম মহানগর
২০২০ সালের ডিসেম্বরে ডা. শাহাদাত হোসেনকে আহ্বায়ক এবং আবু হাশেম বকরকে সদস্য সচিব করে চট্টগ্রাম মহানগর কমিটি গঠন করা হয়। চট্টগ্রামে বিএনপির প্রবীণ নেতা ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান আর দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর আলাদা বলয় থেকে এ কমিটি গঠন করা হয়। অবশ্য আন্দোলনের শুরুতেই আত্মগোপনে চলে যান মহানগরের দুই দায়িত্বশীল নেতা। এর মধ্যে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যান আবু হাশেম বকর। তাদের অনুপস্থিতিতে তৃণমূল কর্মীরা আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করলেও ছিল সমন্বয়হীনতা। ডা. শাহাদাত আত্মগোপনে থেকে কিছুটা কাজ করার চেষ্টা করলেও অন্যরা ছিলেন চুপ। বিশেষত আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী করাবন্দি হওয়ার পর তাঁর অনুসারীদের মাঠে দেখা যায়নি। অন্যদিকে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও মহিলা দলের মতো গুরুত্বপূর্ণ আরেক প্রভাবশালী নেতা ব্যারিস্টার মীর হেলালের নিয়ন্ত্রণে থাকায় তারাও মহানগর বিএনপির নির্দেশে মাঠে নামেননি। দলের কোন্দলে ত্রিশঙ্কু অবস্থায় চট্টগ্রামে কোনো আন্দোলনই গড়ে তুলতে পারেনি বিএনপি। এসব কোন্দলের বাইরে চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীমের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, বিএনপি সাধারণ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আবারও আন্দোলন গড়ে তুলছে।
খুলনা মহানগর
২০২১ সালের ৯ ডিসেম্বর খুলনা মহানগর বিএনপির তিন সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি করা হয়। প্রভাবশালী নেতা নজরুল ইসলাম মঞ্জুর অনুসারীরা এ কমিটির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। তবে আন্দোলনে এ অংশের নেতাকর্মীকে রাজপথে কোনো অবস্থানে দেখা যায়নি। এমনকি দলের হাইকমান্ড থেকে রাজপথে ভূমিকা রাখতে নির্দেশনা দেওয়া হলেও তারা ছিলেন নিষ্ক্রিয়। এদিকে বিগত দিনের দ্বন্দ্ব-কোন্দল দূর করে নতুন কমিটির নেতারা ঘুরে দাঁড়াতে নিজেদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন। দায়িত্ব পাওয়ার পর তৃণমূল থেকে কাউন্সিলের মাধ্যমে থানা ও ওয়ার্ড কমিটি গঠন করেন তারা। নেতাকর্মীরা জানান, বিগত আন্দোলনে সারাদেশে সবচেয়ে বেশি মামলার শিকার হয়েছেন খুলনা বিএনপি নেতাকর্মী। কারাগারেও যেতে হয়েছে বেশি।
মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক শফিকুল আলম মনা বলেন, সংসদ নির্বাচনের আগে আন্দোলন-সংগ্রামে দলের নেতাকর্মীরা বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়ে রাজপথে ছিলেন। মহানগর বিএনপি আগের তুলনায় এখন আরও শক্তিশালী।
বরিশাল মহানগর
বরিশাল মহানগর বিএনপির ৫১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন হয় ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর। তিন মাস মেয়াদি কমিটি এখনও বহাল। আহ্বায়ক কমিটিতে দলের যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ারসহ তাঁর অনুসারীদের বাদ দেওয়ায় তারা ভিন্ন প্ল্যাটফর্মে অবস্থান করছেন। আহ্বায়ক কমিটির ভেতরেও একাধিক উপধারা সৃষ্টি হয়েছে। তাদের মতানৈক্যের কারণে গঠিত ওয়ার্ডের আহ্বায়ক কমিটি নিয়ে পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভ হয়েছে বিগত দিনে। এসব কমিটিতেও সুবিধাবাদী আর অযোগ্যদের স্থান দেওয়া হয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে পুরো আন্দোলনে। নেতাকর্মী জানান, মজিবর রহমান সরোয়ারকে কোণঠাসা করতে গিয়ে বিগত দিনে পুরো বরিশালে বিএনপিকে দুর্বল করা হয়েছে।
নেতারা বলেন, বিগত আন্দোলনে যারা নিজ উদ্যোগে রাজপথে সক্রিয় ছিলেন তাদের নিষ্ক্রিয় করতে তৎপর ছিলেন বিভাগের নেতারা। অন্যদিকে, যেসব কর্মী আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন, কারাগারে গেছেন– তাদের পাশে দাঁড়াতে নেতারা ব্যর্থ হয়েছেন। আর্থিক অনিয়মের অভিযোগও রয়েছে বেশ কয়েক নেতার বিরুদ্ধে। পকেট কমিটি আর অযোগ্যদের সামনে আনতে গিয়ে পুরো সংগঠনকে দুর্বল করেছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। ছাত্রদল, যুবদলের মতো কমিটিও ভাগাভাগি করে নেওয়া হয়েছে বিগত দিনে। আন্দোলন আর সাংগঠনিক কাজে নেতারা তৎপর না থাকলেও ফটোসেশন আর দলের হাইকমান্ডের দৃষ্টি আকর্ষণে চটকদার কার্যক্রমে ব্যস্ত আছেন মহানগর নেতারা। বিএনপি নেতাদের কোন্দলের প্রভাব পড়েছে অঙ্গ সংগঠনেও।
মহানগর বিএনপি প্রসঙ্গে সদস্য সচিব মীর জাহিদ বলেন, দলের ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রামের ব্যস্ততায় আহ্বায়ক কমিটির শূন্য পদগুলো পূরণ হয়নি। একই কারণে সম্মেলন করে পূর্ণাঙ্গ ওয়ার্ড কমিটি গঠিত হয়নি। দলে কোনে উপগ্রুপ নেই বলে তিনি দাবি করেন।
কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, বরিশাল বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব আন্দোলন-সংগ্রামে সফলতা দেখাতে পারেনি। তারা নেতাকর্মীকে ঐক্যবদ্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে। দলাদলি নিয়ে বেশি ব্যস্ত তারা।
রাজশাহী মহানগর
বিএনপির কেন্দ্রীয় এক নেতার একক আধিপত্য বিস্তার নিয়ে পুরো রাজশাহীতে দলের অবস্থা নড়বড়ে। যার প্রভাব পড়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনে। মাঠে দাঁড়াতেই পারেনি মহানগর বিএনপি। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে অ্যাডভোকেট এরশাদ আলী ঈসাকে আহ্বায়ক ও মামুন-অর-রশিদকে সদস্য সচিব করে রাজশাহী মহানগরের কমিটি করা হলেও কোন্দল আর বিভক্তিতে ব্যস্ত ছিলেন তারা।
নেতাকর্মীর অভিযোগ, তাদের নামে অসংখ্য মামলা। অনেকেই দীর্ঘদিন কারাগারে। অথচ আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের সঙ্গে আঁতাত করে চলায় রাজশাহী মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের নামে কোনো মামলা নেই। কখনও গ্রেপ্তারও হন না তারা। আর এ দুর্বল নেতৃত্বের কারণে এক সময়ের বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত রাজশাহী বিএনপি এখন সবচেয়ে দুর্বল।
সিলেট মহানগর
গত বছরের মার্চে কাউন্সিলের মাধ্যমে সিলেট মহানগরের সভাপতি নির্বাচিত হন নাছিম হোসেইন এবং সাধারণ সম্পাদক হন ইমদাদ হোসেন চৌধুরী। সিলেট অঞ্চলে বিএনপি চেয়ারপারসনের দুই উপদেষ্টা খন্দকার মোক্তাদির হোসেন ও আরিফুল হক চৌধুরীর আলাদা বলয়ের বাইরে আন্দোলনের শুরুতে সমন্বয়হীনতায় নেতাকর্মী সেভাবে মাঠে নামতে পারেনি। এর মধ্যে আরিফুল হক চৌধুরী মাঠে প্রকাশ্যে কর্মসূচি পালন করলেও মোক্তাদির হোসেন ছিলেন আত্মগোপনে। যদিও পুরো সিলেটের রাজনীতি তাঁর নিয়ন্ত্রণে। তবে আন্দোলনের শেষের দিকে তিনি নেতাকর্মীকে সংগঠিত করতে ভূমিকা পালন করেছেন বলে নেতাকর্মী জানান।
৭ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের পর এখন পরিস্থিতি অনেকটা পাল্টেছে। দলের কর্মীদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়ে মাঠে নেমেছেন নেতারা। দল পুনর্গঠন, কারাবন্দি নেতাদের পরিবারের খোঁজখবর নেওয়া, নিহত ও আহত পরিবারের সদস্যদের আর্থিক সহযোগিতার মাধ্যমে আবারও সক্রিয় করতে চাইছে দলটি।
নগর বিএনপি সভাপতি নাসিম হোসাইন বলেন, যেসব নেতাকর্মী মুক্তি পাননি কিংবা নতুন করে মামলায় আসামি হয়েছেন, তাদেরকে সার্বিক সহযোগিতা করা হচ্ছে।
রংপুর মহানগর
২০২২ সালের এপ্রিলে রংপুর মহানগর বিএনপির মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। মহানগর বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি সামসুজ্জামান সামুকে আহ্বায়ক ও মহানগর যুবদল সভাপতি মাহফুজ উন-নবী ডনকে সদস্য সচিব করে ৪২ সদস্যের মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মধ্যে মহানগর কমিটির সদস্য সচিব ডন একটি মামলায় ১০ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে ছিলেন দীর্ঘদিন। সম্প্রতি তিনি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।
নেতাকর্মী জানান, প্রত্যাশা থাকলেও রংপুরে রাজপথে তেমন আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেননি নেতারা। তাদের অভিযোগ, শীর্ষ নেতারা ছিলেন আড়ালে। এ কারণে শুধু ফটোসেশন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতার ইশারায় চলে রংপুরের জেলা ও মহানগর বিএনপির কার্যক্রম।
মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সামসুজ্জামান সামু বলেন, সরকারের মামলা, হয়রানি ও নির্যাতনের পরও রংপুর মহানগর বিএনপি অত্যন্ত শক্তিশালী। বিএনপির সব নেতাকর্মী রাজপথে রয়েছেন। নেতাকর্মী ভয়ভীতি উপেক্ষা করে কর্মসূচি পালন করছেন।
কুমিল্লা মহানগর
প্রস্তাবিত এ বিভাগের ‘বড় সমস্যা’ দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে পরিচয়দানকারী আবদুর রহমান সানি। তাঁর হস্তক্ষেপে এ বিভাগের প্রতিটি কমিটিতে ত্যাগী ও যোগ্যরা রয়েছেন বিপদে। ২০২২ সালের মে মাসে কুমিল্লা মহানগরে প্রথমবার আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার পর থেকেই এখানে বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না। কমিটিতে সানির শ্বশুর রাজিউর রহমান রাজীবকে যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়। এ ছাড়া রাজীবের এক ভাইকে যুগ্ম আহ্বায়ক, আরেক ভাইকেও সদস্য করা হয়। অথচ তারা এর আগে বিএনপির কোনো পদে ছিলেন না। এমনকি অতীতের কোনো আন্দোলনেও তাদের দেখা যায়নি। এ নিয়ে অসন্তোষ তৈরি হয় নেতাকর্মীর মধ্যে। কমিটি ঘোষণার রাতেই নেতাকর্মীকে যথাযথ মূল্যায়ন না করায় ঘোষিত কমিটি থেকে আহ্বায়ক আমিরুজ্জামান আমিরসহ ৪৪ সদস্যের কমিটির বেশ কয়েকজন পদত্যাগ করেন। পরে আমিরুজ্জামানকে বিএনপির সব পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
২০২২ সালের ১৫ জুন কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করায় মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক রাজিউর রহমান রাজীব, সেলিম খানসহ আরও কয়েকজনকে কমিটি এবং দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। পরে তিন মাসের মধ্যে ৩১ আগস্ট ফের ২৫ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এতে রাজীব দ্বিতীয় যুগ্ম আহ্বায়ক হন। তারেক রহমানের পিএস পরিচয়দানকারী সানির শ্বশুর হওয়ার কারণে আবারও তাঁকে মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়। এতে ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা। রাজীবকে অতীতে দলীয় কর্মসূচিতে দেখা যায়নি। অথচ দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় অন্যদের দল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার, পদ কেড়ে নেওয়া ও অব্যাহতি দেওয়া হয়। শুধু শ্বশুরকেই কমিটিতে পদায়ন করা হয়নি; পুরো মহানগর, জেলা কমিটিতেও চলছে সানির প্রভাব। ফলে অযোগ্যদেরই কদর ঘটছে পুরো কমিটিতে। যার প্রভাব পড়েছে বিগত আন্দোলনে।
ময়মনসিংহ মহানগর
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে এ কে এম শফিকুল ইসলামকে আহ্বায়ক এবং আবু ওয়াহাব আকন্দকে সদস্য সচিব করে মহানগর কমিটি করা হয়। তবে এখন পর্যন্ত সংগঠনকে শক্তিশালী করতে থানা ও ওয়ার্ড কমিটি গঠন করতে পারেননি নেতারা। ২৮ অক্টোবরের পর বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স ও সহসাংগঠনিক সম্পাদক শরীফুল আলমকে গ্রেপ্তারের পর ময়মনসিংহ মহানগরসহ বিভাগের অন্য ইউনিটে আন্দোলনে ভাটা পড়ে।
মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এ কে এম শফিকুল ইসলাম ও সদস্য সচিব আবু ওয়াহাব আকন্দ আন্দোলন গড়ে তোলার কোনো চেষ্টাই করেননি। আন্দোলনের শুরু থেকেই তারা আত্মগোপনে চলে যান।
আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর দলীয় কার্যালয়ে নেতাকর্মীর আনাগোনা একেবারে কমে গেছে। বিভিন্ন কর্মসূচিতেও দেখা যাচ্ছে না নেতাকর্মীকে। অনেকে কারাবন্দি থেকে জামিনে বের হলেও পরিবারের চাপের মুখে রাজনীতিতে সক্রিয় হতে পারছেন না।
ময়মনসিংহ মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যাপক এ কে এম শফিকুল ইসলাম বলেন, দলে দ্বন্দ্ব নেই, তবে প্রতিযোগিতা আছে।
ফরিদপুর মহানগর
২০২২ সালের ৩১ আগস্ট এ এফ এম কাইয়ুম জঙ্গিকে আহ্বায়ক ও গোলাম মোস্তফা মিরাজকে সদস্য সচিব করে ৩১ সদস্যের প্রথম আহ্বায়ক কমিটি করা হয়। বিভাগীয় সাংগঠনিক জেলায় এখানে মহানগরকেন্দ্রিক কার্যক্রম খুবই সীমিত। মহানগরে ২৭ ওয়ার্ডের মধ্যে ২২টিতে সম্মেলন হয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের আগে থেকে একের পর এক মামলা ও পুলিশি হয়রানিতে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে মহানগর বিএনপির দলীয় কার্যক্রম।
মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব গোলাম মোস্তফা মিরাজ বলেন, সংগঠনের আহ্বায়কসহ অনেক নেতাকে আটক করে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যেও নেতাকর্মী আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন।
গাজীপুর মহানগর
গাজীপুর মহানগরের কমিটিতে থাকাকালীন হাসানউদ্দিন সরকার কর্মীবাহিনী তৈরি করেছিলেন। কিন্তু বর্তমান কমিটি গঠনের পর ফের দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা প্রকাশ পাচ্ছে। এ কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে প্রয়াত আবদুল মান্নানের ছেলে এম মঞ্জুরুল করীম রনিকে রাখা হলেও তিনি দক্ষতা দেখাতে পারেননি। মাঠের আন্দোলনে তো নয়ই, কোনো সাংগঠনিক কাজেও তাঁকে মহানগরের নেতাকর্মীরা পাচ্ছেন না। সভাপতি শওকত হোসেন সরকারও একই পথের পথিক। নেতাকর্মীকে সংগঠিত করে জোরালো আন্দোলনের কোনো চেষ্টাই ছিল না নেতাদের। বিগত আন্দোলনে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মী ছাড়া আর কোনো অঙ্গ সংগঠনকেও মাঠে নামাতে পারেননি মহানগর বিএনপি নেতারা।
নারায়ণগঞ্জ মহানগর
বিগত আন্দোলনে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপি। সিটি করপোরেশন নির্বাচন ঘিরে এখানকার প্রভাবশালী নেতা তৈমূর আলম খন্দকার ও এ টি এম কামালকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বহিষ্কার করা হয়। পরে গত জাতীয় নির্বাচনের আগে তৈমূর কথিত কিংস পার্টি ‘তৃণমূল বিএনপির’ মহাসচিবের দায়িত্ব পেয়ে নির্বাচনেও অংশ নেন।
নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে এ দুই নেতাকে নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও তারাই ছিলেন নেতাকর্মীর কাছে পরিচিত মুখ। তাদের জায়গায় সে রকম কোনো নেতা তৈরি করতে পারেনি বিএনপি।