একের পর এক সংঘাত, ক্ষমতার পালাবদল, নির্বাচনের ডামাডোল, রেকর্ড তাপমাত্রা সব মিলিয়ে ২০২৪ সালকে হয়তো বলা যেতে পারে ‘উত্তাপ’ ছড়ানোর বছর। বলতে গেলে এক রকম টানটান উত্তেজনার মধ্য দিয়ে পার হয়েছে পুরো বছরটি।
পতন, পলায়ন
বিশ্বের নানা অঞ্চলে যুদ্ধ, হামলা–পাল্টা হামলা, রক্তক্ষয়ী আন্দোলন উত্তেজনা তৈরি করেছে। লড়াইয়ের কারণে হাজারো মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, বাস্তুচ্যুত হয়েছেন লাখো শিশু থেকে বৃদ্ধ।
বছরের পর বছর ধরে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা শাসকদের পতনের ঘটনাও সীমানা ছাড়িয়ে আলোচনার ঝড় তৈরি করেছে বিশ্বজুড়ে।
সংঘাতের কারণে যেমন রক্তবন্যা বয়ে গেছে, আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগেও হারিয়েছে অগণিত প্রাণ। রেকর্ড প্রখর উত্তাপ, ঝড়–ঝঞ্ঝা ও বন্যায় অগণিত মানুষের দুর্ভোগ বছরজুড়েই খবরের শিরোনামে জায়গা করে নিয়েছে।
রাজনৈতিক পর্যায়ে এ বছরের বড় নাটকীয় পরিবর্তন বলা যায় বাংলাদেশ ও সিরিয়ার সরকার পতন এবং ক্ষমতাবানদের দেশ ছেড়ে পালানোর ঘটনা।
বাংলাদেশে জুলাই মাসের আন্দোলন, ইন্টারনেট বন্ধ, সহিংসতার ঘটনা বিশ্বজুড়েই খবরের শিরোনাম হয়েছে। খুব কম সময়ে অনেক বেশি রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতির সম্মুখিন হয় বাংলাদেশ।
দেড় দশকেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পালানো এবং পাঁচই অগাস্টের পরিস্থিতি এসব কিছুই হয়ে দাঁড়ায় বৈশ্বিক খবর। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুসের উপদেষ্টা হওয়ার বিষয়টিও ছিল আলোচনায়।
পরবর্তীতে সংখ্যালঘু ইস্যু, সাবেক প্রাধানমন্ত্রীর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের তিক্ততা, গুম–নির্যাতন নিয়ে তদন্ত এমন অনেক বিষয়ই আন্তর্জাতিক খবরে উঠে আসে।
বছরের প্রায় শেষদিকে এসে ২০০০ সাল থেকে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট পদে থাকা বাশার আল আসাদের দুর্গের পতন হয়। দেশ গৃহযুদ্ধে জর্জরিত হলেও মূলত রাশিয়া ও ইরানের সমর্থনের জোরে টিকে ছিলেন আসাদ।
গত বছর আরব লীগে তার প্রত্যাবর্তনকে অনেকটা জয় হিসেবেই দেখা হয়েছিল। যদিও এ দফায় বিদ্রোহীদের দমাতে না পেরে রাশিয়া পালিয়ে যেতে হয়েছে এই নেতাকে। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটলো সিরিয়ায়।
যুদ্ধ, হামলা, সংঘাত
আগে থেকে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ তো চলছিলই, ২০২৩ সালের অক্টোবরে শুরু হওয়া গাজা যুদ্ধও চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায় ২০২৪ সালে। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ৪৫ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে এবং ২০ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
সেখানে নিহতদের মধ্যে ১৩৩ সাংবাদিকও রয়েছেন। এখানেই শেষ নয়, ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড ছাড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ফ্রন্টে ছড়িয়ে পড়ে এই সংঘাত। এছাড়া হামলা–পাল্টা হামলার দিক দিয়ে ইসরায়েলের বাইরে এ বছর ইরানই ছিল সবচেয়ে বেশি আলোচনায়।
মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়া সংঘাতের অনেক দিকেই ছায়ার মতো ছিল ইরান। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দেশটির বহু দিনের ছায়াযুদ্ধ তীব্র আকার নেয় বছরজুড়ে।
বছরটা শুরু হয়েছিল তেসরা জানুয়ারি ইরানে কাসেম সোলেইমানিকে হত্যার বার্ষিকীতে জোড়া বোমা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে। অন্তত ৮৪ জন নিহত হন সেই বিস্ফোরণে।
জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝিতে সেই বোমা হামলার জেরে ইরাক, সিরিয়া ও পাকিস্তানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। ইরাকের কুর্দিস্তান অঞ্চলে ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদের সদর দপ্তর’ লক্ষ্য করে, সিরিয়ার উত্তর–পশ্চিমে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) ঘাঁটির উদ্দেশে এবং পাকিস্তানে ‘জঙ্গিগোষ্ঠী জইশ আল আদলের’ ঘাঁটি লক্ষ্য করে ছিল এই হামলা। জবাবে ইরান সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তানি ‘জঙ্গি গোষ্ঠীর আস্তানা‘ লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে পাকিস্তান।
বিশ্লেষকেরা অবশ্য ইরান–পাকিস্তানের পাল্টাপাল্টি হামলাকে শক্তিমত্তা প্রদর্শনের অংশ হিসেবে দেখেছেন। প্রায় কাছাকাছি সময়ে ইয়েমেনের হুথি গোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য দফায় দফায় হামলা চালায়। ইরান সমর্থিত হুথিরা গাজা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল হুমকির মুখে ফেলেছিল।
আবার সিরিয়ার দামেস্কে বিমান হামলায় ইরানের অভিজাত ইসলামিক বিপ্লবী গার্ডের পাঁচজন উচ্চপদস্থ সদস্যসহ দশজন নিহতের ঘটনায় ইসরাইলকে দায়ী করে ইরান ও সিরিয়া। জানুয়ারির শেষদিকে জর্ডান সীমান্তের কাছে এক মার্কিন ঘাঁটিতে ড্রোন হামলায় তিন মার্কিন সেনা নিহত ও ৪০ জনের বেশি আহত হন।
যুক্তরাষ্ট্র এজন্য ইরানকে দায়ী করলেও ইরান তা অস্বীকার করে। প্রতিশোধ হিসেবে ফেব্রুয়ারির শুরুতে সিরিয়া এবং ইরাকের ৮৫টি লক্ষ্যবস্তুতে যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালায়। ইয়েমেনেও যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের হামলা চলতে থাকে।
পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়ে যখন সিরিয়ায় ইরানের কনস্যুলেট ভবনে ইসরাইলের বিমান হামলায় ইরানি বিপ্লবী গার্ডের কমান্ডারসহ সাত জন কর্মকর্তা নিহত হন। পহেলা এপ্রিলের সে হামলার প্রেক্ষাপটে ১৪ই এপ্রিল ইসরায়েলের ভূখণ্ডে ৩০০র বেশি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে ইরান।
এর মধ্য দিয়ে ইরান–ইসরায়েল প্রথমবারের মতো সরাসরি সংঘাতে জড়ায়। ১৯শে এপ্রিল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ শহর ইস্ফাহানে হামলা হয়। সে হামলায় তেমন গুরুতর কিছু না ঘটলেও সেটাকে ইসরাইলের সক্ষমতা প্রদর্শনের একটা ‘বার্তা‘ হিসেবে দেখেন বিশ্লেষকেরা।
ওদিকে গাজায় ইসরাইলের রাফাহ শহরে অভিযান, আল শিফা হাসপাতালে নতুন অভিযান, ত্রাণ সংকট সব মিলিয়ে মানবিক বিপর্যয় বাড়তেই থাকে। আমেরিকার তফর থেকে ইসরাইলকে অস্ত্র বন্ধের হুমকিও দেওয়া হয়, যদিও সেসব কিছু খুব একটা ধোপে টেকেনি। আর গাজার সূত্র ধরে ক্রমাগত ইসরাইলি বাহিনীকে লক্ষ্য করে লেবাননের দিক থেকে হামলা অব্যাহত রাখে ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ গোষ্ঠী।
সীমান্তে তাদের ওপর পাল্টা হামলা ছাড়াও দক্ষিণ লেবানন সীমান্তে সাদা ফসফরাস (রাসায়নিক) বোমা হামলা চালিয়ে যেতে থাকে ইসরাইল। আমেরিকাসহ বিভিন্ন পশ্চিমা দেশে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে বিক্ষোভও দেখা যায়। ইসরাইলের পক্ষেও পাল্টা অবস্থান দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে।
গাজায় হামাস তো ছিলই, সঙ্গে লেবাননের হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীও বছরজুড়ে ইসরাইলের দিকে হামলা অব্যাহত রাখে। সেপ্টেম্বর মাসে লেবাননে দুই দফায় হাজার খানেক পেজার ও রেডিও ডিভাইস বিস্ফোরণ এবং রাজধানী বৈরুতে বড় পরিসরে হামলা করতে থাকে ইসরায়েল। ২৪ সেপ্টেম্বর এক দিনেই ৪৯২ জন নিহত হন। লেবাননে অনেকটা গাজার মতো করেই হামলা চালিয়ে যায় ইসরাইল।
এমন নানা পরিস্থিতি আর হিজবুল্লাহ, হামাস ও বিপ্লবী গার্ডের শীর্ষ নেতাদের হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে পহেলা অক্টোবর আবারও ইসরাইলে হামলা চালায় ইরান। তাদের প্রায় ২০০ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাবে পাল্টা হামলা করে ইসরাইলও। লেবাননে এক রকম যুদ্ধবিরোধী হলেও ইসরাইলের সঙ্গে দেশটির সংঘাত থেমে নেই।
আবার সিরিয়ায় মিত্র বাশার আল আসাদের পতনের ফলে সেখানে প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে ইরান কিছুটা বেকায়দা পড়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এছাড়া ইয়েমেনের হুথিরা ইসরায়েলের দিকে হামলা করেছে, পাল্টা হামলা করেছে ইসরাইলও। হামলার এই সিলসিলা এখনও চলছে।
মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে আগে থেকে চলতে থাকা বেশ কয়েকটি সংঘাত এবছরও অব্যাহত ছিল। যেমন মিয়ানমারে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধের কারণে অনেক ক্ষেত্রে দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের প্রতিবেশী দেশগুলোতে পালানোর ঘটনা ঘটেছে। বছরের শেষদিকে এসে রাখাইন অঞ্চলের বেশিরভাগ অংশের দখল নেয় বিদ্রোহী আরাকান আর্মি। এর মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো দেশটির সেনাবাহিনী পুরো একটি সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে বলা হচ্ছে।
রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমা সহায়তা অব্যাহত আছে।
এরপরও আগের বছরের তুলনায় চলতি বছর রাশিয়া অন্তত ছয় গুণ বেশি ইউক্রেনীয় ভূমি দখলে নেয়ার তথ্য দিচ্ছে ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অফ ওয়ার বা আইএসডব্লিউ। সেনা সংকট কাটাতে উত্তর কোরিয়া থেকে যোদ্ধা নিয়োগ করেছে রাশিয়া ।
এছাড়া রাশিয়ার অভ্যন্তরে বছরের শুরুতে কনসার্ট হলে হামলা এবং বছর শেষে বৈদ্যুতিক স্কুটারের মধ্যে লুকিয়ে রাখা বোমার বিস্ফোরণে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর একজন জ্যেষ্ঠ জেনারেলের মৃত্যু উঠে এসেছে বিশ্বের খবরে।
আলোচিত মৃত্যু বা হত্যা
আনোয়ারুল আজীম: বাংলাদেশের ঝিনাইদহের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম মে মাসে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় রহস্যজনকভাবে হত্যার শিকার হন। এ ঘটনা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে বাংলাদেশ–ভারত দুই দিকেই।
অ্যালেক্সি নাভালনি: গত এক দশকে রাশিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী পুতিনবিরোধী নেতা অ্যালেক্সেই নাভালনি কারাগারে মারা যান ফেব্রুয়ারি মাসে। কারা কর্তৃপক্ষ দাবি করে, অসুস্থ হয়ে মৃত্যু হয় তার। তবে তার দল ও পশ্চিমা দেশগুলো এই মৃত্যুর জন্য রুশ কর্তৃপক্ষকে দায়ী করে।
এ বছর মধ্যপ্রাচ্য সংঘাতে ব্যাপকহারে বিভিন্ন পর্যায়ের শীর্ষ নেতাদের মৃত্যুর খবর ছিল আলোচনায়। এর মধ্যে ছিলেন–
সালিহ আল–আরোরি (জানুয়ারি): বছরের একদম শুরুতে হামাসের উপ–প্রধান সালিহ আল–আরোরি বৈরুতে ড্রোন হামলায় নিহত হন। হামাসের সামরিক শাখা কাসাম ব্রিগেডের গুরুত্বপূর্ণ এই ব্যক্তি লেবানন থেকে হামাস ও হেজবুল্লাহর মধ্যে যোগসূত্রের কাজ করতেন। সে হামলায় আরও ছয়জন নিহত হন যাদের মধ্যে হামাসের দুই জন সামরিক কমান্ডারও ছিলেন।
মারওয়ান ইসা (মার্চ): ইসরাইলের কাছে মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় থাকা হামাসের অন্যতম শীর্ষ সামরিক কমান্ডার মারওয়ান ইসাকে গাজায় বিমান হামলায় হত্যা করা হয়।
ইব্রাহিম রাইসি (মে): হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ইরানের প্রেসিডেন্ট এব্রাহিম রাইসির মৃত্যু হয় ১৯ মে। বিচার বিভাগীয় ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ রাইসি ছিলেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির ঘনিষ্ঠ ধর্মীয় নেতা।
মোহাম্মদ দেইফ (জুলাই): হামাসের রহস্যময় সামরিক প্রধান মোহাম্মদ দেইফকে বহুদিন ধরে খুঁজেছে ইসরাইল। আগস্ট মাসের ১ তারিখ ইসরাইল ঘোষণা দেয় যে ১৩ জুলাই গাজার খান ইউনিস এলাকায় বিমান হামলায় তাকে হত্যা করেছে তারা।
ইসমাইল হানিয়ে (জুলাই): হামাসের সর্বোচ্চ নেতা এবং রাজনৈতিক শাখার প্রধান ইসমাইল হানিয়েকে ইরানে রকেট হামলায় হত্যা করা হয় ৩১ জুলাই। তিনি কাতার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মিশরের মধ্যস্থতায় গাজায় যুদ্ধবিরতির আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন।
হিজবুল্লাহর শীর্ষ একজন কমান্ডার ফুয়াদ শুকরকে লেবাননে হত্যার কয়েক ঘণ্টা পরই তেহরানে সে হামলা করা হয়।
শেখ হাসান নাসরাল্লাহ (সেপ্টেম্বর): শিয়া ধর্মপ্রচারক ও লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরাল্লাহকে লেবাননে ২৭ সেপ্টেম্বর হত্যা করা হয়।
লেবানন বা ইরান ছাড়াও আরব বিশ্বে তার বাড়তি জনপ্রিয়তার জায়গা ছিল। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির ঘনিষ্ঠ নাসরাল্লাহ আত্মগোপনে থাকলেও সবসময় টেলিভিশনে বক্তৃতা দিতেন এবং রাজনৈতিক দিক দিয়ে যথেষ্ট প্রভাবশালী ছিলেন।
ইয়াহিয়া সিনওয়ার (অক্টোবর): ইসমাইল হানিয়ের পর হামাসের নতুন প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে গাজার রাফাহ শহরের একটি ভবনে ড্রোন হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয়। ভবনটিতে যাওয়ার আগে বন্দুকযুদ্ধের কথাও বলা হয়।
২০১৩ সালের সাতই অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের হামলার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি।
নির্বাচনের বছর
বছরের শুরু থেকেই ২০২৪ সালকে বিশ্বজুড়ে নির্বাচনের বছর হিসেবে দেখা হচ্ছিল। বিশ্বের ৬০টিরও বেশি দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এ বছর।
বছরের শুরুতে বাংলাদেশের নির্বাচনও স্থান পায় আন্তর্জাতিক খবরের শিরোনামে। সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের উপু্র্যুপরি চাপ আর বিতর্কের মধ্য দিয়েই অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচন।
টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসা শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে ভারত, চীন, রাশিয়ার মতো দেশগুলো দ্রুতই অভিনন্দন জানালেও নির্বাচন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে হয়নি বলে জানায় আমেরিকা ও ব্রিটেন।
যদিও যুক্তরাষ্ট্র যতটা শক্ত অবস্থান নেওয়ার ধারণা করা হয়েছিল তার প্রতিফলন নির্বাচনের পর দেখা যায়নি। অবশ্য সে নির্বাচনের ছয় থেকে সাত মাসের মধ্যেই আরো বড় খবরের শিরোনাম হয় বাংলাদেশ। আলোচিত নির্বাচনের মধ্যে ছিল পাকিস্তান, ভারত ও আমেরিকার নির্বাচন।
ফেব্রুয়ামি মাসে পাকিস্তানের নির্বাচন, বিশেষত ইমরান খানকে ঘিরে নানা নাটকীয়তা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের মনোযোগ কেড়ে নিয়েছিল। নির্বাচনের সপ্তাহখানেক আগে দেশের গোপন তথ্য পাচার করার অভিযোগে দশ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয় আগে থেকেই দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়া ইমরান খানকে।
তার দল তেহরিক–ই–ইনসাফ বা পিটিআই–এর ‘ক্রিকেট ব্যাট’ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে না পারার মতো নির্বাচন কমিশনের আইনের কারণে দলের সদস্যরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
স্বতন্ত্র হিসেবেই তারা ২৬৬টি আসনের মধ্যে ৯৩টি আসনে জয় পেয়ে শোরগোল বাঁধিয়ে ফেলেন। পরবর্তীতে ইমরানবিরোধীদের সমঝোতার মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হন শাহবাজ শরিফ।
ভারতে নির্বাচনের আগে বছরের শুরুতেই পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্লোগান দিয়েছিলেন, আবকি বার, চারশো পার! অর্থাৎ ৫৪৩ আসনের মধ্যে ৪০০ পার করার আত্মবিশ্বাস ছিল তার। তবে নির্বাচনে তার দল ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপিকে হোঁচট খেতে হয় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন নিয়েই।
ভারতের লোকসভায় নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে সরকার গঠন করতে হলে একটি দলকে অন্তত ২৭২টি আসন পেতে হয়। বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট সে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও বিজেপি এককভাবে পায় ২৪০টি আসন। অন্যদিকে প্রত্যাশা ছাড়িয়ে বিরোধী ইন্ডিয়া জোট পায় ২৩২টি আসন।
এর মধ্য দিয়ে এক রকম পুনরুত্থান হয় কংগ্রেসের। আর জোটের ওপর ভর করে হলেও তৃতীয়বারের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন মোদী, যেই রেকর্ড শুধু ছিল জওহরলাল নেহরুর। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘিরেও নাটকীয়তা হয়েছে বছরজুড়ে।
জুলাই মাসে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর একটি সমাবেশে হামলা হয়। কানের পাশ দিয়ে চলে যায় গুলি। ট্রাম্পের রক্তমাখা ছবি শিরোনাম হয় গোটা বিশ্বেই।
সেসময় নিরাপত্তা নিয়ে বিতর্ক উঠলেও অনেক ভোটার এটিকে সাজানো নাটকও মনে করেন। অন্যদিকে গাজা যুদ্ধ নিয়ে চাপে থাকা জো বাইডেন বয়স নিয়েও তিনি কম বিতর্কে পড়েননি।
তবে নির্বাচনের মাত্র সোয়া তিন মাস আগে জুলাই মাসে প্রেসিডেন্ট দৌড় থেকে সরে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমালা হ্যারিসকে এগিয়ে দেন বাইডেন। তবে শেষ পর্যন্ত ডেমোক্র্যাটদের হারিয়ে জয়ী হন ট্রাম্প।
এর বাইরে আলোচিত ছিল যুক্তরাজ্যের নির্বাচনও। অক্টোবর–নভেম্বর মাসে সেখানে ভোট হতে পারে ধারণা করা হলেও হুট করে আগেভাগেই জুলাই মাসে নির্বাচন দেয়ার ঘোষণা দেন কনজারভেটিভ পার্টির প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক।
২০১৯ সালের কনজারভেটিভ পার্টির জয়ের পর ২০২৫ সালের জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হওয়ার কথা। তবে বরিস জনসন, লিজ ট্রাস, ঋষি সুনাক, সব মিলিয়ে পাঁচ বছর পূর্ণ হয়নি টোরি সরকারের। ২০২৪ সালের নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছেন লেবার পার্টির স্যার কিয়ের স্টারমার।
রাজনৈতিক নাটকীয়তার বিবেচনায় দক্ষিণ কোরিয়ায় হঠাৎ করে দেশে সামরিক শাসন জারি করে বড় বিতর্কের মুখে পড়েন প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওল। শেষ পর্যন্ত সংসদে ইমপিচ বা অভিশংসিত হয়ে সরকারি দায়িত্ব থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
উষ্ণতম বছর
প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর চরমভাবাপন্ন আবহাওয়াও আলোচনায় বার বার জায়গা করে নিয়েছে এ বছর।
২০২৪ সালকে বিবেচনা করা হচ্ছে বিশ্বের উষ্ণতম বছর হিসেবে। ২০২৩ সালকে উষ্ণতম বলা হলেও কোপার্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিসের মতে এবছর সে রেকর্ডও ছাড়িয়েছে বিশ্ব।
আবহাওয়া চক্র এল নিনোর প্রভাবে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের বিভিন্ন সময়ে ইউরোপ, এশিয়া জুড়ে রেকর্ড ছাড়ানো তাপমাত্রায় হাঁসফাঁস করেছে বিশ্বের মানুষ। সেটার একটা বড় প্রভাব দেখা গেছে হজ করতে যাওয়া মুসলমানদের ওপর। সেখানে তাপমাত্রা ৫১.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পৌঁছায়।
সৌদি আরবের কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, এই বছর হজ পালন করতে গিয়ে ১৩০১ জন হাজির মৃত্যু হয়েছে। সেপ্টেম্বরে দুই দিনের ভারী বৃষ্টিপাতের পর সাহারা মরুভূমির মরোক্কো অংশে আকস্মিক বন্যা দেখা দিয়েছিল যা গত ৫০ বছরে একবারও ঘটেনি।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের দিকে দেখলে সেপ্টেম্বর মাসে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও লাওসের ওপর দিয়ে বয়ে যায় টাইফুন ইয়াগি। এতে এশিয়াজুড়ে পাঁচ শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়।
প্রায় কাছাকাছি সময় হারিক্যান হেলেনের তাণ্ডবে যুক্তরাষ্ট্রের ছয়টি রাজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং শতাধিক মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।
পাপুয়া নিউ গিনিতে গত মে মাসে ভূমিধসে ৬৭০ জন মৃত্যুর কথা জানায় জাতিসংঘ, যদিও দেশটির সরকার এতে দুই হাজারের মতো মানুষ চাপা পড়ার শঙ্কা প্রকাশ করে।
অক্টোবরে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে স্পেনে দুই শতাধিক মানুষ প্রাণ হারান এবং এটাও বলা হচ্ছিলো, গত এক শতাব্দির মধ্যে এরকম বন্যা দেখেনি ইউরোপ।
এদিকে, বছর শেষে বড় দুইটি বিমান দুর্ঘটনা উঠে আসে খবরের শিরোনামে।
২৫ ডিসেম্বর বড় দিনে মধ্য এশিয়ার দেশ কাজাখস্তানে ৬৭ জন আরোহী নিয়ে আজারবাইজান এয়ারলাইন্সের একটি যাত্রীবাহী বিমান বিধ্বস্ত হয়। এই ঘটনায় বিমানের ৩৮ আরোহী নিহত হন।
এরপর ২৯ ডিসেম্বর দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু এয়ারের একটি বিমান ১৮১ জন যাত্রীসহ মুয়ান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হয়। তার মধ্যে ১৭৯ জন নিহত হন এবং কেবল দুই জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা