জাগো নারায়ণগঞ্জ:
রাজধানীর শাহবাগ থেকে ‘বাংলাদেশ বেতার ভবন’ আগারগাঁওয়ে স্থানান্তর শুরু হয় ২০১২ সালে। ২০১৫ সালে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও হয়নি। এর পর তিন দফা ব্যয় বাড়ে। আর প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ে ছয় দফা। সর্বশেষ মেয়াদ বাড়ে গত মার্চে। এমন তিন শতাধিক প্রকল্পে অর্থছাড় বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এমনকি ইতোমধ্যে ছাড় করা অর্থও খরচ করা যাবে না। এতে বেকায়দায় পড়বে ওইসব প্রকল্প।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় নেওয়া অনেক প্রকল্পই নির্ধারিত সময়ে শেষ হয় না। বাস্তবায়নে সময় বাড়ে, ব্যয়ও বাড়ে। এতে প্রকল্পের উদ্দেশ্য সফল হয় না। জনগণ বঞ্চিত হয় সেবা থেকে। এমন বাস্তবতায় উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। যেসব প্রকল্পের কাজ এই অর্থবছরে অর্থাৎ আগামী মাসের মধ্যে শেষ হবে না, সেগুলোর অর্থছাড় বন্ধ হবে। এমনকি এরই মধ্যে ছাড় হওয়া অর্থও ব্যয় করা যাবে না।
গত ১৬ মে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়। এমন ৩৯৫টি প্রকল্পের কথা জানিয়ে এর আগে এনইসিতে অর্থছাড় ও ব্যয় বন্ধের প্রস্তাব পাঠায় পরিকল্পনা কমিশন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৩৯৫টি প্রকল্পের মধ্যে কিছু প্রকল্পের কাজ আগামী জুনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। তার পরও তিন শতাধিক প্রকল্পে অর্থছাড় বন্ধ হয়ে যাবে। সরকারের আলোচিত কিছু প্রকল্পও রয়েছে এই তালিকায়।
এনইসির বৈঠকে উন্নয়ন সহযোগী বা বিদেশি ঋণের প্রকল্পের অগ্রগতি তদারকি করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন সমকালকে বলেন, ‘সময় মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন না হলে অর্থনীতিতে চতুর্মুখী চাপ তৈরি হয়। প্রকল্প থেকে যেসব সেবা যুক্ত হওয়ার কথা, তা হয় না, বাস্তবায়ন ব্যয় বেড়ে যায়। প্রকল্প থেকে ব্যবসা বা বিনিয়োগের যে সুযোগ তৈরি হওয়ার কথা, তাও হয় না। এ কারণে হয় না কাঙ্ক্ষিত কর্মসংস্থান।’
অর্থছাড় নিয়ে যেসব প্রকল্প সমস্যায় পড়বে তার মধ্যে রয়েছে– মেট্রোরেল (ঢাকা মাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট লাইন-৬) প্রকল্প, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প, দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে ঘুনধুম সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্প, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র (মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্রজেক্ট) প্রকল্প, মেট্রোরেলের (লাইন-৫) সাউদার্ন রুট নির্মাণ প্রকল্প ইত্যাদি।
এর মধ্যে মেট্রোরেল প্রকল্প ঢাকা মাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট লাইন-৬-এর কাজ আগামী মাসে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু গত মার্চ পর্যন্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অগ্রগতি ৮৭ শতাংশ এবং অর্থ খরচে অগ্রগতি ৭১ শতাংশ। চলতি অর্থবছর গ্রকল্পটিতে বরাদ্দ রয়েছে ৩ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। এই প্রকল্পে মোট ব্যয় ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
গত মার্চ পর্যন্ত পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নে অগ্রগতি ৮৯ শতাংশ এবং অর্থ খরচে অগ্রগতি ৮১ দশমিক ২৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছর খরচের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদেশি ঋণ ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। প্রকল্পে মোট বরাদ্দ ১৮ হাজার ২১০ কোটি টাকা। রেলপথ মন্ত্রণালয় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। ২০১৬ সালে শুরু হয় এই প্রকল্পের কাজ। এটি সংশোধন হয়েছে একবার।
দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী ঘুনধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১০ সালে। গত মার্চ পর্যন্ত এই প্রকল্পে অর্থ খরচে অগ্রগতি ৪৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ এবং ভৌত অগ্রগতি ৯৫ শতাংশ। এটিও বাস্তবায়ন করছে রেলপথ মন্ত্রণালয়।
পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নে অগ্রগতি ৯২ দশমিক ৬০ শতাংশ এবং অর্থ খরচে অগ্রগতি ৮৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ। ২০১৫ সালে প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। চলতি অর্থবছর এই প্রকল্পে বরাদ্দ রয়েছে ২৫০ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র (মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্রজেক্ট) প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত মার্চে। ওই সময় পর্যন্ত প্রকল্প বাস্তবায়নে অগ্রগতি ৯৭ দশমিক ৬১ শতাংশ এবং অর্থ খরচে অগ্রগতি ৯৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। ১৬ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পের ১৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বিদেশি ঋণ। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ ব্যবস্থাপনার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এটি এডিপিভুক্ত প্রকল্প নয়।
কাজ শেষ হওয়ার আগেই অর্থছাড় বন্ধ হলে প্রকল্পগুলোর পরিণতি কী হবে– জানতে চাইলে আইএমইডির সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন সমকালকে বলেন, ‘প্রকল্প বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করতে সরকার এমন কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিছু প্রকল্পের কাজ অসমাপ্ত রেখেই হয়তো শেষ করতে হবে। আসলে সঠিকভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই না হওয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়।’
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘আইএমইডির পরিদর্শনে দেখা গেছে, শহরে পর্যটন বাস চালানোর মতো প্রকল্প বাংলাদেশে উপযুক্ত নয়। তাই শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি বাদ দিতে বলা হয়েছে। সরকারের কঠোর সিদ্ধান্তের সুফল এই অর্থবছর না হলেও আগামী অর্থবছর পাওয়া যাবে।’ তবে অনেক প্রকল্পের কাজ এ অর্থবছরই শেষ হবে বলে মনে করেন তিনি।
প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে সমস্যা দেখা দেওয়ায় মানসম্পন্ন, নিরপেক্ষ, পেশাদারি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত হয় এনইসির বৈঠকে। এ লক্ষ্যে সরকারি ক্রয় বিধিমালা (পিপিআর) অনুসরণে একটি নীতিমালা করছে আইএমইডি। এ ছাড়া ৫০ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ের প্রকল্পে সম্ভাব্যতা যাচাই বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
আরও যেসব প্রকল্পের অর্থছাড় বন্ধ হতে পারে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ২০০৯ সালে শুরু হওয়া কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্প। প্রকল্পটি সংশোধন হয়েছে তিনবার। চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে ও ট্যাক্সিওয়ের শক্তি বৃদ্ধিকরণ প্রকল্প, যেটি শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২২ সালে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা (ডিএনডি) এলাকার নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন (দ্বিতীয় পর্যায়), তিতাস গ্যাস ফিল্ডে ওয়েল হেড কমপ্রেসর স্থাপন, ওয়েস্ট জোনে বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা সম্প্রসারণ; বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদীর তীর রক্ষা প্রকল্প; চট্টগ্রাম, সিলেট ও রংপুরে গুদাম নির্মাণ প্রকল্প; ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন (চতুর্থ পর্যায়) প্রকল্প; খাদ্য নিরাপত্তা পরিসংখ্যান প্রকল্প; স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের ১৫০ শয্যার কার্ডিও ভাসকুলার ইউনিট স্থাপন ইত্যাদি।