► শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও গ্রামীণ অবকাঠামোয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ ► ছয় মাসে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরানোর কৌশল ► উন্নয়ন ব্যয় জিডিপির ৫ শতাংশের কম রাখা হচ্ছে
মূলত উন্নয়ন ব্যয় জিডিপির ৫ শতাংশের কম রাখা হচ্ছে।
পরিচালন ব্যয়ে তেমন পরিবর্তন আসছে না।
আগামী ৬ জুন অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফেরাতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য প্রায় সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনার বাজেট পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এর আগে গতকাল প্রধানমন্ত্রী এই বাজেটের রূপরেখা নিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ও অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, অর্থ বিভাগের সচিব ড. খায়েরুজ্জামান মজুমদারসহ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী অসুস্থ থাকায় বৈঠকে তিনি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত ছিলেন।
বৈঠকের শুরুতে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীকে দেশের বর্তমান সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকের পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়।
সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী সীমিত ব্যয়ে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়নে তদারকি জোরদার করতে বলেছেন। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চেয়েছেন, যাতে এই রিজার্ভ পর্যায়ক্রমে বাড়ানো সম্ভব হয়। এ জন্য রপ্তানিমুখী শিল্পের সুবিধা বাড়ানো এবং বৈধ পথে প্রবাস আয় বাড়াতে গুরুত্ব দিয়েছেন।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী কৃষি উৎপাদন ঠিক রাখতে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন, যাতে চলমান পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি উসকে না যায়। বর্তমানে বাজারে অনেক খাদ্যপণ্যের দাম বাড়তি। এ পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে জোর দিতে বলেছেন।
জানা যায়, আগামী অর্থবছরের বাজেটের রূপরেখা নিয়ে আলোচনায় খাতভিত্তিক ব্যয় করার জন্য যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, তা প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করা হয়। এ সময় সামাজিক সুরক্ষায় আরো নজর দিতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মূল্যস্ফীতির আঘাত থেকে দরিদ্রদের সুরক্ষায় সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা অন্তত সাড়ে পাঁচ লাখ বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনার পরে কিছু সূচকে বেশি পিছিয়ে থাকার কারণ জানতে চেয়েছেন। সেসব বিষয় নতুন করে বিবেচনায় রেখে বাজেট প্রস্তাব প্রণয়ন করতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতির সহায়ক ভূমিকা রাখতে আর্থিক নীতি ও পরিকল্পনার এই বাজেটে পদক্ষেপ থাকবে। মুদ্রানীতি সংকোচনমূলক। এখন অর্থ মন্ত্রণালয় যদি সম্প্রসারণমূলক আর্থিক নীতিতে যায়, তাহলে তা বিপরীতমুখী হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় মূল্যস্ফীতি কমাতে আগামী বাজেটে সহায়ক পদক্ষেপ নিচ্ছে। আগামী বাজেট সীমিত পরিসরের ঘাটতিতে করা হচ্ছে।
বৈঠকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপস্থাপনায় বলা হয়, বিশ্ব অর্থনীতি ও অভ্যন্তরীণ সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে মুদ্রানীতির সঙ্গে সমন্বয় রেখে আগামী বাজেট কিছুটা সংকোচনমূলক করা হচ্ছে।
চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে ধরে রাখার লক্ষ্য থাকলেও বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও অভ্যন্তরীণ নানা কারণে তা সংশোধিত বাজেটে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়। তবে বাস্তবতায় এটি কিছুটা বাড়বে।
জানা যায়, বাজেটে কাটছাঁট খুব বেশি করা হয়েছে—এমন নয়। তবে কিছু পরিবর্তন করে কম ব্যয় বাড়িয়ে সমন্বয় আনা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে কাটছাঁট করে ১৫ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় কমানো হয়েছে। তবে সামাজিক নিরাপত্তায় ব্যয় বাড়ানো হচ্ছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের ফ্যামিলি কার্ডে পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে ব্যয় বাড়বে।
মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, সরকারের পরিচালন ব্যয়ের ক্ষেত্রে বেতন-ভাতায় খুব বেশি পরিবর্তন নেই। সরবরাহ ও সেবার ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন আছে। কারণ এসব ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যয় বাড়ছে।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) খাতে ব্যয় বাড়বে। প্রকল্পগুলোর খরচ বেড়ে যাবে। উন্নয়ন প্রকল্পে বিদেশি ঋণ ও সহায়তার অংশে আবার ডলারের মূল্য বৃদ্ধিতে টাকার অঙ্কে অর্থ বেশি পাওয়া যাবে। এই প্রকল্পে ডলারে পণ্য ও সেবা আমদানির ক্ষেত্রে হেরফের থাকবে না। তবে এ ক্ষেত্রেও সংকোচনমূলক পরিকল্পনা ঠিক থাকবে।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, সরকারের দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলে দেওয়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়, বেসরকারি খাতে যে পরিমাণ ঋণ নিয়েছে, তার চেয়ে বেশি পরিশোধ করায় ডলার ঘাটতি বেড়েছে। কারণ বিদেশে ঋণের সুদ বেড়ে গেছে। এ কারণে বেসরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়েছে। নতুন করে বেসরকারি খাতে ঋণ কম আসছে। তাই রিজার্ভ কমে আসছে। এ কারণে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি তৈরি হয়েছে। আগামী কয়েক মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ পরিশোধের চাপ কমলে তখন আর্থিক হিসাবের ঘাটতি কমে আসবে। তখন পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী চলতি সপ্তাহের মধ্যে সব কিছু পরিমার্জন করে জাতীয় সংসদে উপস্থাপনের জন্য বাজেট প্রস্তাব প্রণয়ন চূড়ান্ত করবে অর্থ মন্ত্রণালয়।
আসন্ন বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়বে বলে জানিয়েছেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান। একই সঙ্গে তিনি জানান, এবার বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সর্বাধিক অগ্রাধিকার পাচ্ছে।
গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বাজেটবিষয়ক প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনাসংক্রান্ত বিশেষ সভা শেষে প্রতিমন্ত্রী গণমাধ্যমকে বলেছেন, কম আয়ের মানুষকে স্বস্তি দিতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে।
আসন্ন বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের এবারের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন যেন বাজেটে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পায়, সেই নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। এবারের বাজেটে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও গ্রামীণ অবকাঠামো খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ থাকবে বলে তিনি জানান।
বাজেটে কর অবকাশ সুবিধা উঠিয়ে দেওয়া প্রসঙ্গে অর্থ প্রতিমন্ত্রী জানান, যেসব খাত দীর্ঘদিন কর অবকাশ সুবিধা পেয়ে আসছে, সেসব খাতে কর অব্যাহতির সুবিধা উঠিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটি সুনির্দিষ্টভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
বাজেটের অর্থায়নের বিষয়ে বিস্তারিত আজ মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে রাজস্ব বাজেট প্রস্তাব তুলে ধরবেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। এই বৈঠকে সংস্থাটির আয়কর, ভ্যাট ও কাস্টমস অনুবিভাগের নীতি শাখার সদস্য, প্রথম সচিব, দ্বিতীয় সচিব ও বাজেট প্রণয়নকারী দল অংশ নেবে।
জানা গেছে, ভ্যাটহার সব ক্ষেত্রে সমান (১৫ শতাংশ) করা, করপোরেট করহার কমানো, ব্যক্তি খাতে ন্যূনতম কর বাতিলের প্রস্তাব, অব্যাহতি কমিয়ে যৌক্তিক করা, দেশীয় শিল্পের সুরক্ষা নিশ্চিতে পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে এনবিআর কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেবেন প্রধানমন্ত্রী।
আগামী বাজেট ব্যয় পরিকল্পনা
অনেকটা ব্যয় সংকোচন নীতিতে চলতি বাজেটের তুলনায় মাত্র ৪.৬২ শতাংশ বাড়িয়ে প্রায় সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার আগামী বাজেটের রূপরেখা প্রস্তুত করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়, যেখানে গত অর্থবছর আগের অর্থবছরের তুলনায় ১২.৩৫ শতাংশ বাড়িয়ে বাজেট দেওয়া হয়েছিল। নতুন বাজেটে সরকারের পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ৩১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। চলতি বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রয়েছে চার লাখ ৭৫ হাজার ২৮১ কোটি টাকা। পরিচালন বাজেটে ব্যয় বেশ কিছুটা বাড়লেও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ বাড়ছে খুব সামান্য। নতুন বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল দুই লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা।
নতুন বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে প্রায় পাঁচ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে প্রায় দুই লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বাজেট ঘাটতি মেটানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে এক লাখ কোটি টাকার বিদেশি ঋণ পাওয়া যাবে বলে আশা করছে সরকার। বাকি এক লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা দেশের ব্যাংকিং খাতসহ অন্যান্য উৎস থেকে ঋণ দেওয়া হবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন চলতি বাজেটের থেকে কিছু কমিয়ে ৬.৭৫ শতাংশ করা হচ্ছে।