পদকপ্রাপ্তি ও শুদ্ধাচার পুরস্কার নিয়ে প্রশ্ন
পুলিশে নানামুখী আলোচনা
পুলিশ বাহিনীর প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন বেনজীর আহমেদ। ছিলেন পুলিশ মহাপরিদর্শক, র্যাবপ্রধান এবং ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার। এ ছাড়া পুলিশ সদরদপ্তরের ডিআইজি প্রশাসনও ছিলেন তিনি।
চাকরিতে থাকাকালে পুলিশের বেশ কিছু মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারও পেয়েছেন। পাঁচবার পুলিশের সর্বোচ্চ পদক বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল (বিপিএম) লাভ করেন তিনি। এ ছাড়া সততার জন্য পেয়েছেন শুদ্ধাচার পুরস্কার। অথচ সেই বেনজীর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে এখন কোটি কোটি টাকার সম্পত্তির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে। এরই মধ্যে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের জন্য বেনজীর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সম্পদ জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
এখন প্রশ্ন উঠেছে, পুলিশ প্রশাসনের ক্ষমতার শীর্ষে থাকার সময় কোটি কোটি টাকার সম্পদ অর্জন করলেও কেন বেনজীরকে এত এত পদক দেওয়া হলো? বিশেষ করে তাঁর শুদ্ধাচার পুরস্কার পাওয়া নিয়ে তৈরি হয়েছে প্রশ্ন। বেনজীর ও তাঁর পরিবার খবরের শিরোনাম হওয়ার পর পুলিশের ভেতরেও আছে নানা আলোচনা। তবে কেউ এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে চান না।
বেনজীর বাহিনীতে থাকাকালে নীতি-নৈতিকতার ব্যাপারে বিভিন্ন সময় জুনিয়র কর্মকর্তাদের নানা নির্দেশনা দিতেন। সেই জুনিয়র কর্মকর্তারা এখন বলছেন, তারা বেনজীরের ঘটনায় বিব্রত। অভিযোগের ব্যাপারে সাবেক আইজিপির পক্ষ থেকে স্পষ্ট কোনো ব্যাখা না আসায় পুলিশের অনেকেই অস্বস্তিতে আছেন। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, পুলিশের এসব পুরস্কার ভালো কাজের স্বীকৃতির প্রতিফলন নয়। মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার দেওয়ার আগে সঠিকভাবে যাচাই করা উচিত।
পুলিশের ডিআইজি ও তদূর্ধ্ব অন্তত চারজন কর্মকর্তার ভাষ্য, সাবেক কোনো শীর্ষ কর্মকর্তার দুর্নীতি-সংক্রান্ত বিব্রতকর তথ্য সামনে এলে বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে এক ধরনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। পরিবার ও সমাজের কাছে ভিন্ন ধরনের বার্তা যায়। তাই এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে মাঝে মাঝে বাহিনীর ভেতরে বড় ধরনের শুদ্ধি অভিযান চালানো প্রয়োজন। এতে অন্যরা সতর্ক হবেন।
কারও কারও অভিমত, সুশৃঙ্খল বাহিনী হিসেবে পুলিশের প্রত্যেক সদস্যের ব্যাপারে নানা সময় বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। কী ধরনের কর্মকাণ্ডে তারা জড়িত– এসব সেখানে উঠে আসার কথা। যথাযথ গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তাদের দায়িত্বশীল জায়গায় পদায়নের ওপর জোর দেন তারা।
পুলিশ সদরদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০১১, ২০১২, ২০১৪, ২০১৬ ও ২০১৯ সালে সাহসী ভূমিকা, জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযান, রাজনৈতিক সহিংসতা প্রতিরোধ এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অবদানের জন্য বিপিএম পুরস্কার পান বেনজীর। একেকটি বিপিএম পুরস্কার অর্জনে একটি পদক, ১ লাখ টাকা এবং একটি সনদ পেয়েছেন তিনি। এ ছাড়া অতিরিক্ত হিসেবে প্রতিবার পুরস্কারপ্রাপ্তির পর মূল বেতনের সঙ্গে ১ হাজার ৫০০ টাকা ভাতা যোগ হয়েছে।
তবে বেনজীর নিজে পুলিশের সর্বোচ্চ পাঁচটি পুরস্কার নিলেও পরবর্তী সময়ে পদকপ্রত্যাশীদের জন্য নতুন নিয়ম করেছিলেন। সর্বোচ্চ দু’বারের বেশি কেউ এখন বিপিএম পেতে পারবেন না। তাঁর করা এই নতুন নিয়ম নিয়েও পুলিশের অনেকের মধ্যে অসন্তোষ আছে। অনেকে বলছেন, সাহসী কাজ করলে একাধিকবার পুরস্কার পেতে কেন বাধা থাকবে?
২০২০-২১ সালে বেনজীরকে শুদ্ধাচার পুরস্কার দেওয়া হয়। তবে দুদকের তথ্য অনুযায়ী, তিনি ও তাঁর পরিবার ২০২০-২১ সালেই প্রায় ৮৭ দশমিক ৯ একর জমি কিনেছিলেন। এ ছাড়া গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে কিনেছেন প্রায় ৬০০ বিঘা জমি। সংখ্যালঘু অনেককে ভয় দেখিয়ে কম দামে তাঁর বিরুদ্ধে জমি কেনার অভিযোগ রয়েছে। সরকারি কর্মচারী বিধিমালা অনুযায়ী স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে পূর্বানুমোদন প্রয়োজন। কিন্তু বেনজীর আগে থেকে এ অনুমোদন নিয়েছেন কিনা, জানা যায়নি। ২০২১ সালে সেরা করদাতাও হয়েছিলেন বেনজীর।
দুদকের নথি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বেনজীর ও তাঁর পরিবার ২০০৯-২০২৩ সালের মধ্যে অন্তত ২০৪ দশমিক ৫ একর জমি কিনেছেন। এর মধ্যে ১১২ একর জমি কেনেন পুলিশ ও র্যাবপ্রধান থাকাকালে।
পুলিশ আইন অনুযায়ী, বাহিনীর কোনো সদস্য বেআইনি কাজে জড়ালে লঘু ও গুরুদণ্ডের বিধান আছে। গুরুদণ্ডের আওতায় চাকরি থেকে বরখাস্ত, পদাবনতি, পদোন্নতি স্থগিত, বেতন কর্তন, চাকরিকালীন সুযোগ-সুবিধা রহিত করা হয়। গুরুদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করা যায়। লঘুদণ্ড হলে প্রত্যাহার, অপারেশনাল ইউনিট থেকে পুলিশ লাইন্স বা রেঞ্জে সংযুক্ত করা হয়ে থাকে। বিসিএস ক্যাডারের পুলিশ কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে সরকারি চাকরি আইন-২০১৮ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
এদিকে পুলিশের যেসব কর্মকর্তা বেনজীরের বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলার পেছনে ভূমিকা রেখেছিলেন, তাদের অনেকে আতঙ্কে রয়েছেন। এই তালিকায় সার্জেন্ট রুমিসহ বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তা রয়েছেন।
দেশে নেই বেনজীর
বেনজীর এখন কোথায়– এ নিয়ে কিছু দিন ধরেই আছে আলোচনা। তাঁকে প্রকাশ্যে দেখা না যাওয়ায় তাঁর অবস্থান নিয়ে রয়েছে নানা গুঞ্জন। তবে দু’দিন আগে সমকালকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র নিশ্চিত করে, গত ৪ এপ্রিল স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে সিঙ্গাপুর গেছেন তিনি। এর পর সেখান থেকে যান সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে। বর্তমানে তিনি সপরিবারে দুবাই অবস্থান করছেন। এসব বিষয়ে জানতে বেনজীরের মোবাইল ফোন নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।