- কালেরকন্ঠ অনলাইনে প্রকাশিত সংবাদটি জাগো নারায়ণগঞ্জ২৪.কমের পাঠকদের জন্য হুবুহু প্রকাশ করা হলো:
- ৯ খাল নর্দমা, বিপন্ন ৮ খাল
- কেনাবেচা হয়েছে ৭ খাল
বলা হয়ে থাকে প্রাচ্যের ডান্ডি নারায়ণঞ্জ। প্রাচ্যের ডান্ডি হওয়ার পেছনে নারায়ণগঞ্জের ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও পরিবেশই প্রধান কারণ। খাল-নদের কারণে বাণিজ্যের বসতি গড়ে ওঠে এই নারায়ণগঞ্জে। খালগুলো দিয়ে অনায়াসে মালামাল আনা-নেওয়া করা যেত।
কালের বিবর্তনে নারায়ণগঞ্জের সব উপজেলার খালগুলো নানা কারণে বিলীন হয়ে গেছে। অনেক খালের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। ইতিহাসের পাতা থেকে উধাও। বেশ কিছু খাল দখলদাররা অবৈধভাবে দখল করে রেখেছে।
দু’চারটা যা আছে তা-ও ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।
ফলে নারায়ণগঞ্জের পরিবেশ বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছে। পরিবেশ ও পানি সম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান খাল উদ্ধারে মহাপরিকল্পনার উদ্যোগ নিলেও নারায়ণগঞ্জের খালগুলো উদ্ধারে কোনো গতি নেই। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় রয়েছে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্বে।
কিন্তু এখনো অবধি খাল উদ্ধারে বড় সাফল্য দেখাতে পারেননি তারা।
উপজেলাগুলোর তথ্যমতে, জেলার রূপগঞ্জেই রয়েছে ৩১টি খাল। আড়াইহাজারা উপজেলায় ২২টি, সোনারগাঁয়ে ১৩টি, বন্দরে ৯টি, সিদ্ধিরগঞ্জে ৬টি, ফতুল্লায় ৭টি ও শহরে ৩টি খাল রয়েছে। আগে বেশিরভাগ খালের প্রস্থ ছিল ১৫০ ফুটেরও বেশি। এগুলো বৃষ্টির পানি ধারণ ও নিষ্কাশনে ব্যবহার হতো।
স্বাধীনতার পর মাত্র পাঁচ যুগের ব্যবধানে নারায়ণগঞ্জের খাল বিলুপ্ত হয়েছে। যেগুলো রয়েছে তার বেশিরভাগই সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে। ভূমি অফিসের কাছে নেই দখলকারীদের কোনো তালিকা। মাঝে মধ্যে লোক দেখানো কিছু উচ্ছেদ অভিযান চলে। তবে তদারকির অভাবে উচ্ছেদের কয়েক মাস পরেই আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায় এসব খাল।
পরিবেশবিদ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিছু মানুষ মুনাফার চিন্তায় খালগুলো ভরাট করে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনছে। বিদ্যমান খালের অস্তিত্বও আজ হুমকির মুখে। কালের পরিক্রমায় খালের অস্তিত্ব শুধু বিলুপ্তিই হয়নি, সেখানে গড়ে উঠেছে বিশাল বিশাল দালানকোঠা।
খালের ইতিহাস অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাস্তা তৈরি করে ধ্বংস করা হয়েছে। বেশ কিছু খাল কাগজকলমে থাকলেও এগুলোর চিহ্নমাত্রও নেই। এক সময় নারায়ণগঞ্জে ৯১টি খাল সচল ছিল। শীতলক্ষ্যা, মেঘনা ও বালু নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ছিল ওই খালগুলো। নৌকা, স্টিমার চলতো সেসব নদীখালে। সেসময় নৌপথে মালামাল পরিবহণ ও বাণিজ্যিক প্রসার ঘটে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অপরূপ ছিল তখন নারায়ণগঞ্জ। প্রবাহমান নদী ও খালের সুবিধাই মুঘলদের বন্দর প্রতিষ্ঠা করতে উৎসাহিত করে। রাজপ্রাসাদ, দুর্গ রক্ষাসহ রণকৌশল করপোরেশন গড়ে তোলা হয় খালগুলোকে কেন্দ্র করে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী খালের সংখ্যা ৬৭টি। গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের হিসাব অনুযায়ী নারায়ণগঞ্জ জেলায় ৯১টি খালের অস্তিত্ব থাকলেও তার সবই মৃতপ্রায়। স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি খালগুলো উদ্ধারে কোনো অভিযান হয়নি।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন খাল সম্পর্কে ৫৭ পৃষ্ঠার এক বিশদ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। খাল হারিয়ে যাওয়ার সব তথ্য রয়েছে ওই প্রতিবেদনে। নদী কমিশনেরও একই প্রশ্ন-এত খাল হারাল কোথায়? ৩০-৩২ বছর আগেও রূপগঞ্জের প্রান্তসীমায় স্রোতবাহী যেসব খালে পণ্যবাহী বড় বড় নৌকার আনাগোনা ছিল, সে খালগুলো এখন দুই-আড়াই ফুট চওড়া ড্রেনের আকার ধারণ করেছে।
এমনকি সরকারি ওই দপ্তরে বহু খোঁজাখুঁজি করেও খালগুলোর নথি পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশেই প্রভাবশালী মহল বছরের পর বছর ধরে খাল দখলের মচ্ছব চালিয়ে আসছে। আভিযানিক কর্মকর্তাদের কেউ কেউ উচ্ছেদের পরিবর্তে নিজেদের পকেট ভারী করার দিকেই বেশি উৎসাহী থাকেন। প্রভাবশালী দখলবাজদের সঙ্গে গোপন লেনদেন সম্পন্ন হলে মাঝপথেই আটকে যায় উচ্ছেদের অভিযান। ফলে তাদের কব্জা থেকে খালগুলো মুক্ত করাও আর সম্ভব হয় না।
রূপগঞ্জের টাটকী খাল
রূপগঞ্জের লক্ষ্মী খ্যাত টাটকীর খাল এখন স্থানীয়দের কাছে প্রাণঘাতক হিসেবে পরিচিত। এক সময় এ খালটি ছিল রূপগঞ্জের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের অন্যতম মাধ্যম। এ খালটি এখন অবৈধ দখলদারদের কবলে পড়ে আবর্জনা আর রঙের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। টাটকীর খাল ছিল মাছের প্রাণকেন্দ্র, সেই সঙ্গে ছিল কৃষকদের সেচকাজের উৎসস্থল। এ কারণে ১৯৮৪ সালে এ খালকে উৎস করে ৮৩ কোটি টাকা ব্যয়ে অগ্রণী সেচ প্রকল্প চালু করা হয়।
শীতলক্ষ্যা নদী থেকে এ খালের মাধ্যমে পানি এনে স্থানীয় প্রায় দেড় হাজার একর জমি চাষাবাদের আওতায় আনা হয়। রূপগঞ্জের মধ্য দিয়ে উত্তর-দক্ষিণ দিকে বয়ে যাওয়া টাটকীর খালটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৩ কিলোমিটার। এ খালের দু’ধারে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা শিল্প প্রতিষ্ঠান, দোকান-পাটের ময়লা-বর্জ্য, জীবজন্তুর মৃত দেহসহ বিভিন্ন আবর্জনা প্রতিদিন এ খালটিতে ফেলা হয়।
কথিত আছে ১০০ বছরেরও অধিক সময়কাল আগে তৎকালীন জমিদার রামরতন ব্যানার্জি নদীপথে এ এলাকার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধা এবং এলাকার শ্রীবৃদ্ধির লক্ষ্যে রূপগঞ্জের তারাব থেকে যাত্রামুড়া পর্যন্ত খনন করেন, যা টাটকীর খাল নামে পরিচিত। ১৯০৫ সালে খালটি সোনারগাঁয়ের আমগাঁওয়ের ৩ কিলোমিটার পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। এ খালটি দিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে লঞ্চ, পালতোলা ও মালবাহী নৌকা যাতায়াত করত। মারফত আলী বলেন, এ খাল দিয়ে বড় বড় নৌকা চলতো। এখন সব দখল হয়ে গেছে।’
কাশিপুর–ভোলাইল খাল
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার কাশিপুর-ভোলাইল সরকারি খালটি স্থানীয় প্রভাবশালীরা দখল করে রেখেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয়দের দখল আর দূষণ দেখে আর বোঝার কোনো উপায় নেই এটি খাল নাকি ড্রেনের সুয়ারেজ লাইন। খালটি দখলের জন্য স্থানীয় প্রভাবশালীরা প্রতিযোগিতা করছেন। তাল মিলিয়ে খাল দখল করছেন। এমনকি শিল্প-কারখানার মালিকরা খাল দখল করে বিশাল আকারে দেয়াল নির্মাণ করে নিজেদের দখলে নিয়ে যায়।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, কাশিপুর দেওয়ানবাড়ী-ভোলাইল খালটিতে বসতবাড়ির আবর্জনা আর শিল্প-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে খালের পানি দূষিত হয়ে গেছে। এই খাল দিয়ে একসময় চলাচল করতো মালবাহী বড় বড় নৌযান, পাওয়া যেতো সুস্বাদু মাছ। এখন স্থানীয়দের দখলদারিত্বে হারিয়ে গেছে এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী কাশিপুর, ভোলাইল, দেওয়ানবাড়ির খাল। স্থানীয় আওলাদ হোসেন, জুম্মন মিয়া বলেন, য’খন প্রাচ্যের ডান্ডি ছিল নারায়ণগঞ্জ তখন দেশের বিভিন্ন স্থান হতে শীতলক্ষ্যা নদীর সঙ্গে সংযুক্ত টানাবাজার, মন্ডলপাড়া, বাবুরাইল খাল দিয়ে কাশীপুরে মালবাহী বৃহৎ নৌযানের যাতায়াত ছিল। ছোট-বড় দোকান, সামাজিক সাংস্কৃতিক ক্লাবের নামে খাল দখল হয়ে গড়ে উঠেছে শতশত অবৈধ স্থাপনা।’
সোনারগাঁওয়ের পঙ্খিরাজ খাল
নারায়ণগঞ্জ সোনারগাঁ উপজেলার ঐতিহাসিক পঙ্খিরাজ খালটি এখন ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। দখল, দূষণ ও ভরাটের কারণে খালটি এখন সরু নালায় রূপ নিয়েছে। এক সময় খালটি পুরো সোনারগাঁ পৌরসভার পানি নিষ্কাশনের একমাত্র পথ ছিল। বর্তমানে খালটির বিভিন্ন স্থানে ভরাট ও দখলের কারণে খালটিতে পানি প্রবাহ নেই বললেই চলে। সোনারগাঁয়ে মেঘনা নদীর শাখা মেনিখালীর সঙ্গে এ খালের সরাসরি সংযোগ ছিল। খালটি উদ্ধবগঞ্জ এলাকার ভট্টপুর দিয়ে ঐতিহাসিক পানাম নগরে প্রবেশ করেছে। এক সময় এ খাল দিয়েই দেশী-বিদেশী বণিকরা পানাম নগরে যাতায়াত করত।
ভট্টপুর গ্রামের করিম শেখ বলেন, ‘এ খাল দিয়ে আমাদের ব্যবসায়িক মালামাল আনা নেয়া করতাম। নৌকায় মানুষ পারাপার হতো এ খালটি দিয়ে। প্রভাবশালীরা খালটি প্রায় দখল করে নিয়েছে। তার সঙ্গে সঙ্গে ময়লা ফেলে ভরাট করছে।’
স্থানীয় বাসিন্দা কেরামত আলী বলেন, ‘পঙ্খিরাজ খালটি অনেক পুরনো, খালটিকে ঘিরে অনেক ইতিহাস রয়েছে। খালটি পুনরুদ্ধারের জন্য উর্ধতন কর্মকর্তাদের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছি এবং মানববন্ধন করেছি। কিন্তু প্রশাসন খালটি উদ্ধারে চোখে পড়ার মতো কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় আমরা হতাশ।’
সোনারগাঁও উপজেলার শত বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী আরেকটি বেহাকৈর খাল। উপজেলার কাঁচপুর ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রাম থেকে শুরু হয়ে সাদিপুর ইউনিয়নের কাজীপাড়া গ্রাম পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে খালটি বিস্তৃত। খালটির প্রায় পুরোটাই দখল হয়ে গেছে।
পরিবেশ রক্ষা ও উন্নয়ন সোসাইটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘মহামান্য হাইকোর্ট নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা করেছেন। অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও প্রভাবশালীদের দখলে চলে যাচ্ছে খালবিল।’
যা বলছে প্রশাসন
রূপগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) তারিকুল আলম বলেন, ‘খাল দখলের অভিযোগ পেয়েছি। আমরা তালিকা তৈরি করে অভিযান পরিচালনা করব।’
নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক রাশেদ মাহমুদ বলেন, ‘দূষণ রোধে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। খাল উদ্ধারের দায়িত্বতো আমাদের নেই।’
রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা শীঘ্রই অভিযানে নামব।’
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. জাহিদুল ইসলাম মিঞা বলেন, ‘খাল দখলের অনেক অভিযোগ আছে। ইতোমধ্যে বন্দরের একটি খাল দখলমুক্ত করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে শহর ও উপজেলার খালগুলো অভিযান চালিয়ে দখলমুক্ত করা হবে।’