সংস্কারের দ্বিতীয় দফা সংলাপে কিছুটা নমনীয়তা দেখিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংস্কার করে অর্থবিল, আস্থা-অনাস্থা ভোট, সংবিধান সংশোধন প্রস্তাব ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে দলের বিরুদ্ধে এমপিদের ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা দিতে একমত হয়েছে বিএনপি, জামায়াতসহ অধিকাংশ দল। এনসিপি চায় সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রেও দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন এমপিরা।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফা সংলাপের প্রথম দিনে ৭০ অনুচ্ছেদ, নারী আসন এবং সংসদীয় স্থায়ী কমিটি নিয়ে আলোচনা হয়। স্থায়ী কমিটি নিয়ে দলগুলোর অবস্থান কাছাকাছি হলেও নারী আসন নিয়ে মতপার্থক্য দূর হয়নি।
বিএনপি নারী আসন ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১০০ করতে রাজি। তবে সরাসরি নির্বাচন নয়, বিদ্যমান সংরক্ষিত পদ্ধতি চায় তারা। জামায়াত ভোটের অনুপাতে নারী আসনের বণ্টন চায়। এনসিপি সরাসরি নির্বাচন চায়। চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস নারী আসনই চায় না। বামপন্থি দলগুলো নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন চায়। আলোচ্যসূচিতে থাকলেও সময়ের অভাবে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়সীমা এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচনের সুপারিশ নিয়ে আলোচনা হয়নি।
গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় শুরু হয়ে মাঝে এক ঘণ্টা বিরতি দিয়ে বিকেল ৫টা পর্যন্ত চলা সংলাপ সরাসরি সম্প্রচার করে বাংলাদেশ টেলিভিশন। ৩০টি রাজনৈতিক দল এবং জোটের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে সংলাপে সভাপতিত্ব করেন ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি সমাপনীতে জানান, ঈদুল আজহার ছুটির পর ফের সংলাপ শুরু হবে।
সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন এবং দুর্নীতি কমিশন সংস্কারে গঠিত কমিশনগুলোর ১৬৬ সুপারিশে ৩৩ রাজনৈতিক দল এবং জোটের মতামত নিয়ে গত মার্চ থেকে প্রথম দফার সংলাপ করে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন ঐকমত্য কমিশন।
প্রথম দফায় প্রতিটি দল এবং জোটের সঙ্গে পৃথকভাবে বসেছিল কমিশন। দ্বিতীয় ধাপে সব দল একসঙ্গে বসছে। বৈঠক সূত্র জানায়, বিএনপি এবং প্রধান দলগুলো আগের তুলনায় নমনীয় ছিল। তবে বিএনপির মিত্র এবং যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলো কঠোর অবস্থানে ছিল।
৭০ অনুচ্ছেদে কাছাকাছি দলগুলো কমিশন প্রস্তাব করেছিল সংসদ সদস্যরা অর্থবিল বাদে বাকি সব বিষয়ে স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবেন। এতে রাজি হয়নি বিএনপি, জামায়াতসহ অধিকাংশ দল। গতকাল সংলাপে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ দলীয় অবস্থান তুলে ধরে বলেন, অর্থবিল ছাড়া আস্থা-অনাস্থা ও সংবিধান সংশোধন প্রস্তাব এবং জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয় বাদে অন্য সব বিষয়ে এমপিরা দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন।
জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের দলীয় অবস্থান তুলে ধরে বলেন, অর্থবিল, আস্থা-অনাস্থা ও সংবিধান সংশোধন প্রস্তাব ছাড়া বাকি বিষয়ে ভোটদানে স্বাধীন থাকবেন এমপিরা।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, সংবিধান সংশোধন প্রস্তাবে এমপিদের ভোটদানে স্বাধীনতা থাকতে হবে। তবে সরকারের স্থিতিশীলতার জন্য আস্থা-অনাস্থা প্রস্তাবে এমপিদের দলীয় নির্দেশনা ভোট দিতে হবে।
অন্য সব দল ৭০ অনুচ্ছেদ সংস্কার করে অর্থবিল, আস্থা-অনাস্থা ও সংবিধান সংশোধন প্রস্তাব ছাড়া বাকি বিষয়ে এমপিদের ভোটদানে স্বাধীনতা দেওয়ার পক্ষে বলেন।
সংলাপ শেষে সালাহউদ্দিন সাংবাদিকদের প্রশ্নে বলেন, যদি কোনো সময় যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়, তখন যাতে এমপিরা দলের বিরুদ্ধে না যেতে পারে, সেই জন্য ৭০ অনুচ্ছেদে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে বিএনপি ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেবে।
এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যু এলে দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে সব রাজনৈতিক শক্তির একসঙ্গে থাকা উচিত। এখানে অস্পষ্ট অবস্থান সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
কিছু স্থায়ী কমিটি বিরোধী দলকে দিতে ঐকমত্য
বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ অধিকাংশ দল সংসদের সরকারি হিসাব সম্পর্কিত কমিটি (পিএসি), সরকারি প্রতিশ্রুতি কমিটি, সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং প্রিভিলেজ কমিটির সভাপতি পদ বিরোধী দলের এমপিদের দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে।
মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কমিটিগুলোর পদও বিরোধী দলকে ছেড়ে দিতে আপত্তি নেই বলে জানায় বিএনপি। তবে কোন কোন কমিটি বিরোধী দলকে ছাড়া হবে, তা পরবর্তী সংসদে আলোচনায় ঠিক হবে বলে সংলাপে জানান সালাহউদ্দিন আহমেদ।
জামায়াতের ডা. তাহের বলেন, তাদের দলও বিরোধী দলকে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদ ছেড়ে দিতে একমত।
কমিশন প্রস্তাব করেছিল, ৫০ শতাংশ কমিটির সভাপতি বিরোধী দলের এমপিরা হবেন। এনসিপি প্রস্তাব করেছিল, স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির পদ বিরোধী দলের এমপিদের দিতে হবে।
সংলাপের পর সালাহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, বিরোধী দলকে সব স্থায়ী কমিটির প্রধানের পদ দেওয়া বাস্তবসম্মত প্রস্তাব নয়। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত কিছু কমিটির সভাপতি পদ দিতে বিএনপির আপত্তি নেই। কিন্তু কোন কোন কমিটি দেওয়া হবে, তা সংসদের আলোচনায় ঠিক করতে হবে। কারণ সংসদে বিরোধী দলের আকার কেমন হবে, তা গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো বড় বিরোধী দল থাকতে পারে, আবার ছোট বিরোধী দলও থাকতে পারে। শুধু কি প্রধান বিরোধী দলকেই স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদ দেওয়া হবে– এর জবাবও পেতে হবে। কোনো দল ৫-১০ আসন পেয়ে প্রধান নয়, কিন্তু বিরোধী দল হলো। তারা কি সভাপতি পদ পাবে না? এসব আলোচনা সংসদে হতে হবে।
সারজিস আলম ব্রিফিংয়ে বলেন, সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে সরকারি দলের সদস্য সংখ্যাই বেশি থাকে। ফলে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোর কমিটির সভাপতির পদ প্রাপ্ত ভোট অনুযায়ী বিরোধী দলগুলোর মধ্যে বণ্টনের প্রস্তাব দিয়েছে এনসিপি। বিরোধী দল বলতে শুধু একটি দল নয়; দ্বিতীয় ও তৃতীয় সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া দলগুলোকেও সভাপতি পদ দিতে হবে।
নারী আসনে বড় মতপার্থক্য
কমিশনের প্রস্তাব ছিল, সংসদের নিম্নকক্ষের আসন সংখ্যা বাড়িয়ে ৪০০ করা। ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে ১০০ আসন সংরক্ষিত থাকবে নারীদের জন্য। বিদ্যমান পদ্ধতিতে যে দল সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে যত শতাংশ পায়, সংরক্ষিত ৫০ নারী আসনের তত শতাংশ পায়।
বিদ্যমান পদ্ধতি অব্যাহত রাখার পক্ষে যুক্তি দিয়ে সংলাপে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, নারী আসনের মেয়াদ বৃদ্ধিতে কয়েক বছর পরপর সংবিধান সংশোধন করতে হয়। তাই নির্দিষ্ট সময়ের বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়া যাতে পারে। বিদ্যমান পদ্ধতিতে আসন বণ্টন হলে নারী আসন বৃদ্ধি করে ১০০ করলে আপত্তি নেই বিএনপির।
জামায়াতের ডা. তাহের সংলাপে বলেন, বিদ্যমান পদ্ধতি নয়; সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নারী আসন বণ্টন হতে পারে। যে দল সাধারণ নির্বাচনে যত শতাংশ ভোট পাবে, তত শতাংশ নারী আসন পাবে।
এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. তাসলিম জারা সংলাপে নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের পক্ষে যুক্তি দেন। তিনি বলেন, ’৭৩ থেকেই সংরক্ষিত নারী আসন রয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন হয়নি। তাই সরাসরি নির্বাচন হতে হবে।
ব্রিফিংয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, কিছু দল বাদে বাকি সবাই নারী আসন বৃদ্ধির পক্ষে। নির্বাচন পদ্ধতি কী হবে, সে বিষয়ে কোনো ঐক্য এখনও হয়নি। আরও আলোচনার জন্য রেখে দেওয়া হয়েছে। একমত না হলে বিদ্যমান পদ্ধতিই ভালো।
ঘূর্ণায়মান পদ্ধতির বিরোধিতা করে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক বা সংসদীয় সংস্কৃতিতে এখনই প্রয়োগযোগ্য নয়। দেশের নারীসমাজের এখনও সে রকম অগ্রগতি হয়নি।
নারীদের এগিয়ে নিতে সরাসরি নির্বাচনের পরিবর্তে সংরক্ষিত আসনের বিধান রাখা উচিত। সমাজ একটা পর্যায়ে পৌঁছালে তখন আর হয়তো বিশেষ বিধান রাখার প্রয়োজন না-ও হতে পারে।
সংরক্ষিত নারী আসনের বিরোধিতা করে খেলাফত মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের বলেন, নারী আসনের দরকার নেই। আর যদি রাখতেই হয়, তবে আনুপাতিক পদ্ধতিতে রাখতে হবে।
ইসলামী আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন বলেন, তাঁর দল আনুপাতিক নির্বাচন চায়। দল ঠিক করবে– নারী, নাকি পুরুষ প্রার্থী দেবে।
জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহিদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, গণসংহতির প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকিসহ অন্য নেতারা নারী আসন বৃদ্ধিকে সমর্থন করেন।
সারজিস আলম বলেন, সংরক্ষিত নারী আসন নেতাদের পরিবার, আত্মীয়দের পুরস্কার দেওয়া হয়। তা বন্ধে সরাসরি নির্বাচন হতে হবে।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘যেসব বিষয়ে সব রাজনৈতিক দল ন্যূনতম ঐকমত্যে পৌঁছাবে, সেগুলো নিয়ে জুলাই সনদ হবে। জাতীয় সনদে কেবল সেসব প্রস্তাবই অন্তর্ভুক্ত করতে চাই, যেগুলোতে দলগুলোর সম্মতি থাকবে। প্রতিটি বিষয়ে একমত হওয়া না গেলেও আমাদের কিছু উপসংহার টানতেই হবে; বিশেষ করে সময়ের সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রেখে। কমিশনের লক্ষ্য জুলাই সনদ চূড়ান্ত করা।’
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় সংলাপে ছিলেন কমিশনের সদস্য সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া।
সংগৃহিত