বিবিসি বাংলা
রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে পরিবর্তন বা সংস্কারের প্রশ্নে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বড় রকমের ভিন্নমত বা পাল্টাপাল্টি অবস্থান দেখা যাচ্ছে।
যদিও অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তাদের সংস্কারের প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে। কিন্তু তাতে ভিন্নমত বা মতপার্থক্য দূর হওয়ার কোনো ইঙ্গিত এখনো পাওয়া যাচ্ছে না।
অন্যদিকে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের নেতৃত্বে গঠিত দল জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত। তারা আবার নতুন সংবিধান ও গণপরিষদ নির্বাচন চাইছে।
বিএনপিসহ বেশিরভাগ দল থেকে একেবারে বিপরীত অবস্থান নতুন এই দলটির।
প্রশ্ন হচ্ছে, মৌলিক বিষয়গুলোতে সংস্কারের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা কি আদৌ সম্ভব? জাতীয় ঐকমত্য কমিশন অবশ্য হাল ছাড়তে চায় না।
এই কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বিবিসি বাংলাকে বলেন, দলগুলোর সঙ্গে চলমান আলোচনায় তারা ভিন্নমতের কারণ জানার চেষ্টা করছেন। একইসঙ্গে তাদের সংস্কারের প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা রয়েছে।
বড় দলগুলো যখন একে অপরের বিপরীত অবস্থান নিচ্ছে, তখন সংবিধান ও রাষ্ট্র পরিচালনা সম্পর্কিত মৌলিক বিষয়গুলোয় ঐকমত্য বেশ কঠিন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
তারা বলছেন, দলগুলো তাদের দলীয় রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে যেতে পারছে না।
গত বছরের পাঁচই অগাস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর গঠিত অর্ন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের প্রস্তাব তৈরির জন্য ১১টি কমিশন গঠন করে।
এর মধ্যে সংবিধান, বিচারবিভাগ, নির্বাচন ব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন, ও পুলিশ-এ সব বিষয়ে ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
মূলত সংবিধান সংস্কারের স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আপত্তি, ভিন্নমত বা মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে।
বিএনপি, জামায়াতের ভিন্নমত কোন ক্ষেত্রে
সংবিধান ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি পারিবর্তনের প্রশ্নেই বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী পাল্টাপাল্টি অবস্থান নিয়েছে।
সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্র’ অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছে।
এ ব্যাপারে কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ একটি বহুত্ববাদী, বহুজাতি, বহুধর্মী, বহুভাষী ও বহু সংস্কৃতির দেশ, যেখানে সব সম্প্রদায়ের সহাবস্থান ও যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিত করা হবে।’
কমিশনের এই প্রস্তাবের সঙ্গে একমত নয় বিএনপি। ভিন্নমত পোষণ করে দলটি বলেছে, সংবিধানের ৮, ৯, ১০ ও ১২ অনুচ্ছেদ পঞ্চদশ সংশোধনীর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার পক্ষে তারা।
সংবিধানের ৮ অনুচ্ছেদে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হয়েছে। আর অনুচ্ছেদ ৯, ১০, ও ১২-এ জাতীয়তাবাদ, সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে।
বিএনপি কি তাহলে ধর্মনিরপেক্ষতায় ফিরে যেতে চায়––এমন প্রশ্নও তুলছেন দলটির সমালোচকেরা।
আর এই সমালোচনার মুখে বিএনপি বলেছে, তারা তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনের সময় আনা পঞ্চম সংশোধনীতে ফিরে যেতে চায়।
সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতেই সর্বশক্তিমান ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসের কথা বলা হয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ তাদের দলের পক্ষে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে মতামত তুলে ধরেছেন।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, তারা মূলনীতিতে পরিবর্তন চান না, সেটাই তারা বলেছেন। সেখানে পঞ্চদশ সংশোধনীর আগের অবস্থায় এবং পঞ্চম সংশোধনীতে ফিরে গেলে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসের কথা থাকছে; ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয় আসছে না।
এই মূলনীতি সংস্কারের প্রশ্নে বিএনপির বিপরীত অবস্থান নিয়েছে তাদের এক সময়ের জোট শরিক জামায়াতে ইসলামী। দলটি সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে।
জামায়াত শুধু একটি শব্দ ‘বহুত্ববাদ’ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে। তারা এর পরিবর্তে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, ধর্মীয় এবং সামাজিক মূল্যবোধ, এই শব্দগুলো যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে।
এই ইস্যুতে অন্য ইসলামী ও বামপন্থিদলগুলোও বিএনপি এবং জামায়াতকে অনুসরণ করে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান নিয়েছে।
তবে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির পরিবর্তন না করে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে ফিরে যাওয়ার যে কথা বিএনপি বলছে, সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে বিএনপির অবস্থান কী হবে-এই আলোচনাও উঠছে। কারণ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করা হয়েছে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে।
এমন সমালোচনার জবাবে বিএনপি নেতাদের বক্তব্য হচ্ছে, তারা রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির প্রশ্নে পঞ্চম সংশোধনীতে ফিরে যাওয়ার কথা বলছেন। কিন্তু অষ্টম সংশোধনী বাতিলের কথা বলছেন না তারা।
সাংবিধানিক কমিশন, জরুরি অবস্থা ঘোষণা নিয়েও মতভেদ
বিএনপিসহ বিভিন্ন দল জাতীয় সাংবিধানিক কমিশন গঠনে সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের পক্ষে নয়। রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে এমন কমিশন গঠনের ব্যাপারে জামায়াতেরও আপত্তি রয়েছে।
সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, জাতীয় সাংবিধানিক কমিশনের (এনসিসি) সিদ্ধান্তক্রমে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারবেন। এ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে বিএনপি।
দলটির নেতারা বলেছেন, জরুরি অবস্থা জারির সঙ্গে সরকারের নির্বাহী কর্তৃত্বের বিষয়টি সম্পর্কিত, সেকারণে এ ক্ষমতা সরকার ও সংসদের বাইরে অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে থাকা সংগত হবে না।
এছাড়া জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হলে সে সময় নাগরিকদের কোনো অধিকার রদ বা স্থগিত করা যাবে না এবং আদালতে যাওয়ার অধিকার বন্ধ বা স্থগিত করা যাবে না। তাই সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪১(খ) এবং অনুচ্ছেদ ১৪১(গ) বাতিল হবে–– এমন সুপারিশও করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন।
এ প্রশ্নেও আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, নাগরিকদের কোনো অধিকার রদ বা স্থগিত না করে জরুরি অবস্থা জারির কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে, প্রস্তাবিত সুপারিশে তা বোধগম্য নয়।
সংস্কারে মত দিলেও নতুন সংবিধান চায় এনসিপি
জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি থেকে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র’ অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে।
তবে সংবিধান সংস্কার কমিশন রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তনের যে সুপারিশ করেছে, তাতে আপত্তি জানিয়েছে এনসিপি।
এখন রাষ্ট্রের নাম রয়েছে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। সেখানে পরিবর্তন এনে ‘নাগরিকতন্ত্র’ ও ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দগুলো ব্যবহারের সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন।
এনসিপি ‘প্রজাতন্ত্র’ ও ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ বহাল রাখার পক্ষে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং অন্যান্য দলগুলোও রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তন চায় না।
তবে এনসিপি বর্তমান সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান চাইছে। সেজন্য তারা গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি তুলেছে। দলটির ব্যাখ্যা হচ্ছে, নির্বাচন একবারই হবে। সেই নির্বাচনে যারা জয়ী হবে, তারা প্রথমে গণপরিষদ গঠন করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবে।
এই নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই পরে সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। অর্থাৎ তাদের দিয়েই সংসদ গঠিত হবে।
এনসিপি’র এই দাবির সঙ্গে বিএনপি, জামায়াতসহ বেশিরভাগ দলই একমত নয়। এই ইস্যুতেই অন্যান্য দলের সঙ্গে এনসিপি’র মতপার্থক্য বেশি।
অবশ্য এনসিপি’র সদস্য সচিব আখতার হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, তারা তাদের দাবি নিয়ে এগোবেন। সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে যে সিদ্ধান্ত নেবে, সে ব্যাপারে তাদের সমর্থন থাকবে।
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য, উচ্চকক্ষ গঠনের প্রক্রিয়া নিয়েও আপত্তি
সরকারের মেয়াদ চার বছর করার প্রস্তাবে এখন সক্রিয় সব দলেরই আপত্তি রয়েছে। তারা পাঁচ বছর মেয়াদের কোনো পরিবর্তন চায় না।
একই ব্যক্তি একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও দলীয় প্রধানের পদে থাকতে পারবেন না বলে সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাব করেছে, এ নিয়ে বড় আপত্তি বিএনপির।
দলটির বক্তব্য হচ্ছে, এটি রাজনৈতিক দলের নিজেদের সিদ্ধান্তের বিষয়। এ ব্যাপারে পরিবর্তন বা সংস্কারের কোনো প্রয়োজন নেই।
জামায়াত অবশ্য বলছে, সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী এক ব্যক্তি হতে পারেন। দলীয় প্রধান অন্য কেউ থাকতে পারেন।
টানা দুই মেয়াদের বেশি এক ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না, এই প্রস্তাব বিএনপির ৩১ দফায় ছিল। কিন্তু দলটি সেখান থেকে সরে এসেছে।
তারা এখন এক ব্যক্তির টানা তিন বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা বলছে।
তবে বামপন্থি দলগুলো ও অন্যান্য ইসলামী দল সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত। তারা মনে করে, এক ব্যক্তি তিন পদে থাকার কারণে ‘একনায়ক’ বা ‘স্বৈরাচার’ হওয়ার সুযোগ থাকছে।
অন্যদিকে, জাতীয় সংসদ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করার প্রস্তাবে ভিন্নমত নেই দলগুলোর।
প্রস্তাব হচ্ছে, সংসদের নিম্নকক্ষে আসন থাকবে ৪০০, নির্বাচন হবে বর্তমান পদ্ধতিতে। এর মধ্যে ১০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। তারা নির্বাচিত হবেন সরাসরি ভোটে।
আর উচ্চকক্ষে আসন থাকবে ১০৫টি। নির্বাচন হবে আনুপাতিক পদ্ধতিতে। সংসদের দুই কক্ষ মিলিয়ে মোট আসন হবে ৫০৫টি।
উচ্চকক্ষ গঠনের প্রক্রিয়া এবং ১০০ নারী আসনে সরাসরি ভোট নিয়েও আপত্তি রয়েছে বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের।
সংসদ সদস্যদের ভোটের স্বাধীনতা দিতে চায় না দলগুলো
বিদ্যমান সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা আছে, সংসদ সদস্যরা নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারবেন না। তাতে এ-ও বলা আছে, কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হিসেবে কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি যদি ওই দল থেকে পদত্যাগ করেন বা সংসদে ওই দলের বিপক্ষে ভোট দেন, তাহলে সংসদে তার আসন শূন্য হবে।
এটি সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে রয়েছে। ফলে সংসদে কোনো আইন পাসের ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যদের ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলা ছাড়া বিপক্ষে ভোট দেওয়ার সুযোগ নেই।
সংবিধানের এই ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তনের বিষয়ে বিভিন্ন সময় আলোচনা হয়েছে। কিন্তু যে দলগুলো ক্ষমতায় বা বিরোধীদলে থেকেছে, তারা কখনও পরিবর্তন চায়নি।
এখনো এ ব্যাপারে পরিবর্তন আনার সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে আপত্তি দলগুলোর।
বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং এমনকি এনসিপি সংসদ সদস্যদের নিজ দলের বিরুদ্ধে গিয়ে অনাস্থা প্রস্তাবে ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা দিতে চায় না।
কমিশনের প্রস্তাব হচ্ছে, অর্থবিল ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে সংসদের নিম্নকক্ষের সদস্যদের নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে। এর সঙ্গে একমত নয় এই দলগুলো।
তারা চায়, অর্থবিলের মতো আস্থা ভোটের ক্ষেত্রেও সংসদ সদস্যরা স্বাধীন থাকবেন না। সংসদ সদস্যদের নিজ দলের অবস্থানের পক্ষেই থাকতে হবে।
ঐকমত্য কি সম্ভব?
সংবিধান ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিসহ স্পর্শকাতর বিষয়গুলোতেই মতভেদ রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের পাশাপাশি রাজনীতিকদেরও অনেকে বলছেন, সংস্কারের এসব বিষয়ে ঐকমত্য বা এক অবস্থানে দলগুলোকে আনা বেশ কঠিন।
বিএনপির মিত্র জোট গণতন্ত্র মঞ্চেরই অন্যতম একজন নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না বিবিসিকে বলেন, মূল বিষয়গুলোতে ঐকমত্য হওয়ার সম্ভবনা কম বলেই তিনি মনে করেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা ব্যাখ্যা করছেন ভিন্নভাবে। তারা মনে করেন, মৌলিক বা স্পর্শকাতর নয়, এমন বিষয়গুলোতে ঐকমত্য হতে পারে। সে অনুযায়ী ঐকমত্য কমিশন হয়তো সরকারের প্রতিশ্রতি অনুযায়ী জুলাই চার্টার তৈরি করতে পারে।
কিন্তু রাষ্ট্রের মূল বিষয়গুলোতে ভিন্নমত, বিতর্কের অবসান না হলে সংস্কার অর্থবহ কতটা হবে, সেই প্রশ্ন থেকে যাবে।
লেখক ও বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বিবিসিকে বলেন, “দলগুলো তাদের দলীয় রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অবস্থান নিচ্ছে। সেজন্য ঐকমত্য হওয়া বেশ কঠিন।”
ঐকমত্য হলেও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা কি সম্ভব?
বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ও কমিউনিস্ট পার্টিসহ বেশিরভাগ দল এখন নির্বাচন সর্ম্পকিত প্রয়োজনীয় সংস্কার করে ভোট চাইছে।
আর এনসিপি ও গণঅধিকার পরিষদসহ কয়েকটি দল সামগ্রিক সংস্কার শেষ করার পর নির্বাচনের কথা বলছে।
যে দলগুলো ন্যুনতম সংস্কার করে নির্বাচন চাইছে, তারা বলছে–– বাকি সংস্কার করবে নির্বাচিত সরকার।
বিএনপির ক্ষমতায় যাওযাটা এখন সময়ের ব্যাপার, ভােট হলেই তারা ক্ষমতায় যাবে–– এমন একটা মনোভাব দলটির সবপর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে।
ফলে দলটির পক্ষ থেকেই জোর দিয়ে বলা হচ্ছে, নির্বাচিত সরকার এসে বাকি সংস্কারগুলো করবে।
কিন্তু কোনো দল নির্বাচিত হয়ে এসে প্রস্তাবিত সংস্কার কাজ কতটা বাস্তবায়ন করবে, এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেই সন্দেহ রয়েছে। যাদের ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা নেই, তাদের দিক থেকেই এই সন্দেহ বেশি।
এমন পরিস্থিতিকে অন্তর্বর্তী সরকার এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনও বিবেচনায় নিচ্ছে। সে কারণে যে বিষয়গুলোতে ঐকমত্য হবে, তা নিয়ে জুলাই চার্টার তৈরি করার কথা বলা হচ্ছে এবং তাতে দলগুলোর নেতাদের স্বাক্ষর করতে হবে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে তারা দলগুলোর সঙ্গে প্রথম পর্যায়ের আলোচনা শেষ করবেন। এই আলোচনায় তারা ঐকমত্য ও দ্বিমতের বিষয়গুলো চিহ্নিত করবেন।
এর ভিত্তিতে জুলাই চার্টার বা অঙ্গীকারনামা তৈরি করবেন তারা।
এছাড়া বাস্তবায়নের জন্য চাপ রাখতে চার্টারের কোনো আইনগত ভিত্তি দেওয়ার সুযোগ আছে কি না, সেটাও ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় রয়েছে বলে জানা গেছে।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, অঙ্গীকার ও চাপ থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা প্রয়োজন।