ক্ষমতার অপব্যবহার, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখল ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অর্থসম্পদের মালিক হয়েছেন সাবেক হুইপ নজরুল ইসলাম বাবু। নামে-বেনামে দেশে-বিদেশে রয়েছে তাঁর সম্পদ, যা বৈধ আয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এই তথ্য।
এর আগে নজরুল ইসলাম বাবুকে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে দুই দফা অব্যাহতি দেওয়া হলেও ক্যাসিনোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান অব্যাহত রেখেছে দুদক।
২০০৮ সালে নারায়ণগঞ্জ-২ (আড়াইহাজার) আসনে আওয়ামী লীগ থেকে প্রথম এমপি হন নজরুল ইসলাম বাবু। এর পরই তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বাড়তে থাকে। মালয়েশিয়ায় তাঁর বাড়ি-প্লট এবং স্ত্রী সায়মা ইসলাম ইভার নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকার তথ্য পেয়েছে দুদক।
চারবারের এমপি নজরুল ইসলাম বাবুর বিরুদ্ধে ২০১৯ সাল থেকে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করে আসছিল দুদক। তাঁর বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ জমা পড়ে দুইবার। নানাভাবে তদবির করে তিনি সেই অভিযোগের অনুসন্ধান থামিয়ে দেন। একই বছর দুদক ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু করে। এতে নজরুল ইসলাম বাবু ও তাঁর স্ত্রী সায়মা ইসলামের নাম আসে। দুদক এই অভিযোগ অনুসন্ধান করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। অনুসন্ধানে দুদক নজরুল ইসলাম বাবু ও তাঁর পরিবারের বিপুল স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য পেয়েছে, যা তাঁর বৈধ আয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
রাজধানীতে রয়েছে ৩ ফ্ল্যাট
দুদকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নজরুল ইসলাম বাবুর রাজধানীর গুলশান-১ এর ১৫ নম্বর রোডের ১ নম্বর প্লটের র্যাংগস ওয়াটার ফ্রন্ট ভবনে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। ৩,২৩৮ বর্গফুটের ফ্ল্যাটটির দাম ৮ কোটি টাকা। তবে বাবু তাঁর হিসাব বিবরণীতে এটির দাম দেখিয়েছেন ৮১ লাখ টাকা। এ ছাড়া, সিদ্ধেশ্বরীর মনোয়ারা হাসপাতালের পাশে হাফিজ টাওয়ারে তাঁর একটি ফ্ল্যাট রয়েছে, যেখানে থাকেন তাঁর বোন শিরিনা আক্তার। ২১৭০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটটির দাম ২ কোটি ৭২ লাখ টাকা। শান্তিনগরের ৮৮ ইস্টার্ন পেয়ার ভবনেও তাঁর একটি ফ্ল্যাট রয়েছে, যার দাম অন্তত ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
এ ছাড়া, ঢাকার পূর্বাচলে রাজউকের ১০ কাঠার প্লটের মালিক নজরুল ইসলাম বাবু, যার দাম ৪ কোটি টাকা।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে তাঁর কয়েক কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে বলে জানা যায়। গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্সে স্টার ট্রেডিং করপোরেশনে তাঁর বিনিয়োগ রয়েছে ৯৫ লাখ টাকা।
সোনারগাঁ ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি
নজরুল ইসলাম বাবু ও তাঁর স্ত্রী ঢাকার গ্রিনরোডে সোনারগাঁ ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি। এই ইউনিভার্সিটিতে তাদের শেয়ার ২৫ শতাংশ।
আড়াইহাজারে দুই ডুপ্লেক্স বাড়ি
আড়াইহাজার সদরে কৃষ্ণপুরা মৌজায় নজরুল ইসলাম বাবুর একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি রয়েছে, যার দাম ২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এ ছাড়া, বাজবী মৌজায় তাঁর আরেকটি ডুপ্লেক্স বাড়ির তথ্য পাওয়া গেছে। এটি তাঁর পৈতৃক বাড়ি। আগের টিনশেড বাড়ি ভেঙে তিনি এটি বানিয়েছেন। ৮ শতাংশ জমির ওপর নির্মিত এই বাড়ির দাম ১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
দুদকে জমা হওয়া অভিযোগ অনুযায়ী, আড়াইহাজারের দুপতারা এলাকায় সূচনা সাইজিং মিলসের মালিক নজরুল ইসলাম বাবু। এই প্রতিষ্ঠানে তাঁর বিনিয়োগ ৩ কোটি টাকা।
দুদক বলছে, নরসিংদীর তিনগাঁও মৌজায় বাবুর ১৪১.৩৭ শতাংশ জমি রয়েছে যার দাম ২ কোটি ৮১ লাখ টাকা। তবে, দুদকে দেওয়া হিসাবে তিনি এই জমির দাম দেখান ৯৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা। একই মৌজায় তাঁর ২১৭.৩০ শতাংশ জমির দাম ৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা। অথচ দুদকে দেওয়া হিসাবে এটির দাম ৭১ লাখ ৮০ হাজার টাকা উল্লেখ করেন বাবু। এখানে তাঁর আরেকটি ৩৩.১৩ শতাংশ জমি রয়েছে, যার দাম ১ কোটি ৫১ লাখ টাকা। বাবুর হিসাবে এটির দাম ২২ লাখ ১ হাজার টাকা।
বিদেশে বিপুল সম্পদ
দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, মালয়েশিয়ায় ৯৭ Persiaraw Duta Duta, Nusantara, Sri Haotamas, Kuala Lumpur ঠিকানায় নজরুল ইসলাম বাবুর একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি রয়েছে, যার দাম অন্তত ১ কোটি ১১ লাখ টাকা। দেশটিতে তাঁর স্ত্রী সায়মা ইসলামের নামে Lot 21 Taman, Perindustrain, Nilai Nilai-2, Seremban, Kuala Lumpur, Malaysia ঠিকানায় রয়েছে একটি বাণিজ্যিক প্লট, যার দাম অন্তত ৯৫ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। এ ছাড়া, মালয়েশিয়ায় বাবুর নামে LOT-7, 29+7.30, TKT 7, IMBI Plaza, Jalan D IMBI, Kuala Lumpur ঠিকানায় একটি কোম্পানি রয়েছে, যার নিবন্ধন নম্বর 88856-H।
যা বলছে দুদক
দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আকতারুল ইসলাম সমকালকে জানান, নজরুল ইসলাম বাবু ও তাঁর স্ত্রী সায়মা ইসলামের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান চলছে। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংস্থাটির শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বাবু ও তাঁর স্ত্রীর জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের তথ্য-প্রমাণ আমাদের হাতে আছে। ইতোপূর্বে নানা কারণে অভিযোগের অনুসন্ধান শেষ করতে সময় লেগেছে। অভিযোগ থেকে অব্যাহতির ঘটনাও ঘটেছে। তবে সর্বশেষ যে অভিযোগ, সেটির অনুসন্ধান জোরদার করা হয়েছে।’
এ বিষয়ে নজরুল ইসলাম বাবুর বক্তব্য জানার জন্য তাঁর মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। এ কারণে তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
সুত্র: সমকাল