চাঁদাবাজি, লুটপাট, ছিনতাই, জবরদখল, ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণসহ সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে সব ধরনের অপকর্ম এখন তাদের নিত্য দিনের কাজ। থানা পুলিশকে ম্যানেজ করেই এসব অপকর্ম করছেন তারা। এলাকার সবকিছুই বাপ-বেটার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। দলীয় শৃংখলাভঙ্গের অভিযোগে ইতোমধ্যে থানা কমিটির সদস্য পদ থেকে বহিস্কার করা হয়েছে ওই বিএনপি নেতাকে।
এলাকাবাসী ও ভূক্তভোগীরা জানান, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার গত ৫ আগষ্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। এর পর থেকে পুরো নারায়ণগঞ্জ এলাকার সকল কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করছেন জেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটির সদস্য অকিল উদ্দিন ভুইয়া ও তার ছেলে আলী ইউসুফ ভূইয়া সম্রাট।
ট্যাংকলরী শ্রমিক ইউনিয়ন পদ্মা ডিপো শাখার সভাপতি আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম জাহিদের অফিস দখল করে নেন তার ছেলে আলী ইউসুফ ভুইয়া সম্রাট। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ট্যাংকলরী শ্রমিক ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি হাজী আব্দুল মতিন মুন্সি ও সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম রেজা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যানের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
তবে অকিল উদ্দিন ভুইয়া ঢাকা বিভাগীয় ট্যাংকলরী মালিক সমিতির গোদনাইল শাখার সভাপতি পদটি বাগিয়ে নেন। তার ছেলে আলী ইউসুফ ভূইয়া সম্রাটকে ওই কমিটির দপ্তর সম্পাদক বানানো হয়। এই কমিটিতে আরো রয়েছেন, আওয়ামী লীগের দোসর সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের ঘনিষ্ট হিসেবে পরিচিত কমিটির কার্যকরি সভাপতি মোসলেম উদ্দিন, সিনিয়র সহসভাপতি আব্দুল জব্বার, সহসভাপতি দেলোয়ার হোসেন ভূইয়া, সহসম্পাদক ইয়ার হোসেন ভূইয়াসহ আওয়ামী লীগের একটি সিন্ডিকেট। এই কমিটিতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের স্থান দেওয়ায় বেশ সমালোচনার ঝড় বইছে এলাকায়।
জুলাই অভূত্থানের পর ফ্যাসিস্টরা এলাকা থেকে পালিয়ে গেলে বিএনপি নেতা অকিল উদ্দিন ভূইয়া ও তার ছেলে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তার ছেলে গোদনাইল মীরপাড়া এলাকায় খোরশেদ মিয়া নামে এক বিএনপি কর্মীকে পিটিয়ে মাথা ফাটিয়ে গুরুতর আহত করে। পরে তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ছয় নাম্বার ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজুল ইসলাম মন্ডলের বাড়িঘরে হামলা ও লুটপাট ও সাবেক চেয়ারম্যান শাহ আলমের বাড়িঘরে হামলা ভাঙচুর লুটপাট চালিয়ে তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে অকিল উদ্দিন ভুইয়া ও তার ছেলে আলী ইউসুফ ভুইয়া সম্রাট।
এ ছাড়া শীতলক্ষা নদীর তীরে অনুপ মিয়ার অবৈধ চোরাই তেলের দোকানদারকে ভয়ভীতি দেখিয়ে অবৈধভাবে চোরাই তেলের ব্যবসা পরিচালনা করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন অকিল উদ্দিন ভূইয়া ও তার ছেলে আলী ইউসুফ ভুইয়া সম্রাট।
ওই এলাকায় শীতলক্ষা নদীর পাড়ে ড্রেজার থেকেও প্রতিমাসে মোটা অংকের টাকা আদায় করছেন পিতা ও পুত্র।
দলীয় সূত্র জানা যায়, এডঃ তৈমুর আলম খন্দকার জেলা বিএনপির আহ্বায়ক থাকা অবস্থায় অকিল উদ্দিন ভূঁইয়াকে সভাপতি ও মনির হোসেনকে সাধারণ সম্পাদক করে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ৬ নং ওয়ার্ড বিএনপির কমিটি ঘোষনা করা হয়। পরে সাবেক সংসদ সদস্য মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন জেলা বিএনপির সভাপতি হলে ওই কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি করা হয়। তার পরও অকিল উদ্দিন নিজেকে ৬ নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি দাবি করে পাঁচ অগস্টের পর থেকে এলাকায় বিভিন্ন অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে। কয়েক মাসের ব্যবধানে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তার নামে। তার এসব অপকর্মে দলের ভাবমুর্তি চরমভাবে ক্ষুন্ন হচ্ছে বলে মনে করছেন বিএনপির মাঠ পর্যায়ের ত্যাগী নেতাকর্মীরা। তাই দলীয়ভাবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করার জন্য দাবি জানিয়েছেন তারা।
গত ৫ নভেম্বর দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড করে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করার অভিযোগে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপির সদস্য ও দলীয় সকল সদস্য পদ থেকে অকিল উদ্দিন ভুইয়াকে বহিস্কার করা হয়। সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপির সভাপতি মাজেদুল ইসলাম ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও অনৈতিক কাজকর্ম করে দলের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার কারণে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার বিএনপির সদস্য অকিলউদ্দিন ভূঁইয়াকে দলের সব পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হলো। এই বহিষ্কার আদেশ জারি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই এলাকার এক ব্যক্তি জানান, অকিল উদ্দিন ভুইয়া ও তার ছেলে আলী ইউসুফ ভুইয়া সম্রাটের হাত থেকে ওই এলাকার হাবসি বিল্লাল (রাঃ) মাদ্রাসাটিও রেহাই পায়নি। পাঁচ আগষ্টের পর তাদের নেতৃত্বে সন্ত্রাসী বাহিনীরা মাদ্রাসার গেইট ভাঙচুর করে মাদ্রাসাটির ভিতরে প্রবেশ করে মাদ্রাসার এসিসহ মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়।
আব্বাস মিয়া নামে বার্মাষ্ট্যান্ড এলাকার এক বাসিন্দা জানান, আওয়ামী লীগ সরকার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর পুরো এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেন নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটির সদস্য অকিল উদ্দিন ভুইয়া ও তার ছেলে আলী ইউসুফ ভুইয়া সম্রাট। পুরো এলাকার ব্যবসা বাণিজ্য থেকে শুরু করে সকল কিছু জবর দখল করে নেন তারা। তার ছেলে আলী ইউসুফ ভুইয়া সম্রাট রাতের বেলায় প্রকাশ্যে দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাড়া মহল্লায় অস্ত্রের মহড়া দিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে আতংক সৃষ্টি করেন। এছাড়া অটো ছিনতাই, মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তিনি বন্ধ হয়ে যাওয়া ইব্রাহিম টেক্সটাইল মিলের জায়গা দখল করে মাদক ব্যবসায়ীদের নিয়ে রাতভর মাদক সেবন করেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটির সদস্য অকিল উদ্দিন ভুইয়া কালের কণ্ঠকে জানান, ‘আমি কোনো অন্যায় কাজের সাথে জড়িত নই। তবে ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করি। আওয়ামী লীগ সরকার আমলে অনেক হামলা মামলার শিকার হয়ে নির্যাতিত হয়ে একাধিকবার কারাবরণ করেছি। আমার বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্র করছে আমার প্রতিপক্ষের লোকেরা।’
সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপির সভাপতি মাজেদুল ইসলাম কালের কন্ঠকে জানান, ‘দলীয় শৃংখলা ভঙ্গের অভিযোগে অকিল উদ্দিন ভুইয়াকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়েছে।’
নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির যুগ্ন আহবায়ক মাশুকুল ইসলাম রাজিব কালের কণ্ঠকে জানান, ‘বিএনপির নাম ভাঙ্গিয়ে কোনো ব্যক্তি কোনো অপকর্মের সাথে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে দলীয় ভাবে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।’
নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার কালের কণ্ঠকে জানান, ‘অপরাধের সাথে জড়িত যেই হোক না কেন তাদেরকে চিহিৃত করে আইনের আওতায় আনা হবে।’
কালের কণ্ঠ