ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার আমানুল্লাহই খুলনার শীর্ষ চরমপন্থী নেতা শিমুল ভূঁইয়া। তার পরিবারের একাধিক সদস্য ও পুলিশ বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তাকে গ্রেপ্তারের পর নৃশংসভাবে সংসদ সদস্য আনারকে হত্যা এবং লাশ গুমের ভয়ংকর পরিকল্পনায় শিউরে উঠেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তবে এমন ভয়ংকর কাজ শিমুলের জন্য এটাই প্রথম নয়, এর আগেও একাধিক হত্যা, ডাকাতিসহ বহু ঘটনার জন্ম দিয়েছেন শিমুল।
যেভাবে চরমপন্থী দলে যোগ দেন
একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার নথির তথ্যানুযায়ী, চরমপন্থী নেতা ফজল মোহাম্মদ ভূঁইয়া ওরফে মাহমুদ হাসান ওরফে শিমুল ভূঁইয়া ওরফে শিহাব ১৯৭০ সালের ৪ মে খুলনার ফুলতলা উপজেলার দামোদর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা নাসির উদ্দিন ভূঁইয়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ক্লার্ক ছিলেন।
শিমুল দামোদর মুক্তময়ী মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে দ্বিতীয় বিভাগ, ফুলতলা কলেজ থেকে এইচএসসিতে দ্বিতীয় বিভাগ এবং ১৯৯১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিষয়ে অনার্স পাস করেন।
তার ৫ ভাই ও ২ বোন রয়েছে। ১৯৮৬ সালে শিমুলের বোন লুচি খানমের সঙ্গে তার ফুফাতো ভাই ঝিনাইদহ জেলার কোটচাঁদপুর উপজেলা সদরের ডা. মিজানুর রহমান টুটুলের বিয়ে হয়। শিমুল তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিষয়ে অনার্সের ছাত্র। আর ডা. টুটুল পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা। ওই বছর কার্ল মার্কস ও চারু মজুমদারের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শিমুল পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। মূলত ডা. টুটুলের পরামর্শ ও দীক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নাম লেখান চরমপন্থী দলে। ১৯৯১ সালে তাকে খুলনায় পার্টির সদস্য করা হয়।
পুলিশের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ অঞ্চলের এক সময়ের ভয়ংকর জনযুদ্ধ নেতা আবদুর রশিদ মালিথা ওরফে তপন যখন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির বিভাগীয় কমিটির সদস্য ছিলেন, তখন শিমুল ছিলেন ওই কমিটির সম্পাদক।
একের পর হত্যা মিশনে শিমুল
১৯৯১ সালের শেষের দিকে শিমুলসহ পাঁচজন খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার শৈলগাতী বাজারে একটি সশস্ত্র গ্রুপের নেতা এমরান গাজীকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর স্থানীয় লোকজন তাদেরকে তিনটি অস্ত্রসহ আটক করে ডুমুরিয়া থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। পরে এমরান গাজী হত্যা মামলায় শিমুলের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। ওই মামলায় শিমুল ১৯৯১ সালের ২৩ ডিসেম্বর থেকে ১৯৯৭ সালের ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত কারাগারে ছিলেন। পরে হাইকোর্টে আপিলের মাধ্যমে হত্যাসহ ৩টি মামলায় জামিনে মুক্তি পান।
শিমুল ১৯৯৬ সালে যশোর কারা বিদ্রোহে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। এ ব্যাপারে ১৯৯৬ সালের ২২ ডিসেম্বর যশোর কোতয়ালী থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। ১৯৯৭ সালের ১৪ এপ্রিল তার জামিন হয়। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি জামিনের নির্দিষ্ট সময়সীমা পার হওয়ার পর পুনরায় আর আদালতে হাজিরা না দিয়ে পলাতক ছিলেন।
তিনি ১৯৯৭ সালে যশোর কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পাওয়ার পরে নগরীর বয়রা সিএসডি গোডাউন এলাকার হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক আবুল কাশেমের মেয়ে সাবিনা ইয়াসমিন মুক্তাকে বিয়ে করেন। ১৯৯৮ সালের শেষের দিকে পার্টির শীর্ষ নেতারা তাকে যশোর অঞ্চলে কাজ করার দায়িত্ব দেয়।
১৯৯৮ সালের ২ জুন শিমুলসহ ৫-৬ জন দামোদর গ্রামের সেলিম সরদারকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি ও বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। খবর পেয়ে পুলিশ সেলিমকে উদ্ধার করে। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে ফুলতলা থানায় মামলা এবং পরবর্তীতে পুলিশ তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে।
১৯৯৮ সালের ১১ জুন পুলিশ শিমুলের বাড়ি ঘেরাও করলে শিমুল ও তার সহযোগীরা গুলি চালায়। এ সময় কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হয় এবং শিমুল পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় পরদিন তার বিরুদ্ধে মামলা এবং পরে এ মামলায় পুলিশ চার্জশিট দাখিল করে।
১৯৯৮ সালের ১৮ আগস্ট দুপুরে ফুলতলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে দামোদর ইউপি চেয়ারম্যান সরদার আবুল কাশেমকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই দিন শিমুল ও তার ৫ সহযোগীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। এ মামলায় পরে শিমুলের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। তবে মামলাটিতে তিনি উচ্চ আদালত থেকে জামিনে রয়েছেন।
১৯৯৮ সালের ১১ নভেম্বর শিমুল ও তার সহযোগীরা ফুলতলা বাজারের ব্যবসায়ী ওয়াজেদ মোল্লার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ঢুকে ৯০ হাজার টাকা লুট, গুলি ছোড়ে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ঘটনায় ১৩ নভেম্বর তার বিরুদ্ধে মামলা এবং পরে পুলিশ চার্জশিট দেয়।
১৯৯৯ সালের ২০ মে রাতে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পেছনে পার্টির সদস্য গণেশকে জবাই করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার পরদিন নগরীর সোনডাঙ্গা থানায় শিমুল ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে মামলা হয়। শিমুল ও তার ৮-৯ জন সহযোগী এই হত্যাকাণ্ড ঘটান বলে অভিযোগ রয়েছে।
১৯৯৯ সালে সরকার চরমপন্থীদের আত্মসমর্পনের সুযোগ দিলে তার কয়েকজন সহযোগী আত্মসমর্পণ করে, তবে শিমুল তাতে সাড়া দেয়নি। ২০০০ সালের ২৯ মার্চ তার বিরুদ্ধে ডুমুরিয়া থানায় একটি হত্যা ও ১২ মে ফুলতলা থানায় একটি হত্যাচেষ্টা মামলা হয়। পরে ২৫ মে পার্টির নেতাদের নিয়ে যশোরে সভা করতে গেলে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন শিমুল। ২০১৩ সালের ১৫ জুলাই জামিনে যশোর কারাগার থেকে বেরিয়ে যান। এরপর থেকেই ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন তিনি।
২০১০ সালের ১৬ আগস্ট নিহত কাশেমের ছেলে ও দামোদর ইউপি চেয়ারম্যান আবু সাঈদ বাদলকে গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটে। কারাগারে থাকা শিমুলের নির্দেশে তার সহযোগীরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটান বলে অভিযোগ রয়েছে। ওই মামলার চার্জশিটে অবশ্য শিমুলের নাম আসেনি।
২০১৭ সালের ২৫ মে রাতে নিজ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে গুলি করে হত্যা করা হয় ফুলতলা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সরদার আলাউদ্দিন মিঠুকে। এ ঘটনায় মিঠুর ভাই রাজ সরদার বাদী হয়ে ২৭ মে ফুলতলা থানায় মামলা করেন।
২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর আদালতে চার্জশিট জমা দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও ফুলতলা থানার ওসি মনিরুল ইসলাম। চার্জশিটে শিমুল ভূঁইয়াকে প্রধান আসামি ও তার স্ত্রী মুক্তাকে ৪নং আসামি করা হয়। পরে অধিকতর তদন্ত শেষে ২০২২ সালের ১০ মে আদালতে চার্জশিট জমা দেন পিবিআইয়ের পুলিশ পরিদর্শক মো. শহীদুল্লাহ। অধিকতর তদন্তের চার্জশিটে শিমুলকে প্রধান এবং মুক্তাকে ৭ নম্বর আসামি করা হয়। মামলাটি পুনরায় সিআইডি তদন্ত করছে।
ফুলতলা থানার ওসি মো. রফিকুল ইসলাম জানান, শিমুলের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। সেগুলোর নথি ও সংখ্যা খুঁজে দেখা হচ্ছে। তবে কোনো মামলায় বর্তমানে তার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট পেন্ডিং নেই।
খুলনার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাইদুর রহমান বলেন, সরদার আলাউদ্দিন মিঠু হত্যার পর শিমুলকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করা হয়। দেশে না থাকায় তাকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। নতুন কোনো হত্যাকাণ্ডে শিমুলের নাম আসছে কিনা খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।