মধ্যরাতে উত্তাল হয়ে উঠেছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস
ষ্টাফ রিপোর্টার:
সরকারি চাকুরিতে কোটা সংস্কার এর দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মিছিল সমাবেশে মধ্যরাতে উত্তাল হয়ে উঠেছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। কয়েকটি ক্যাম্পাসে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে।
সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিলকারীরা আবাসিক হলগুলো থেকে বেরিয়ে এসে ‘তুমি কে আমি কে – রাজাকার, রাজাকার’, ‘কে বলেছে কে বলেছে- সরকার সরকার’ ‘চাইতে গেলাম অধিকার- হয়ে গেলাম রাজাকার’ এবং ‘কোটা নয় মেধা- মেধা মেধা- এ ধরনের শ্লোগান দিয়ে মিছিল করতে থাকে।
অবশ্য ঢাকাসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের একটি অংশের ‘তুমি কে আমি কে – রাজাকার, রাজাকার’ নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে। ছাত্ররা অবশ্য বলছে ‘প্রধানমন্ত্রী সবাইকে রাজাকার বলায় তারা এমন শ্লোগান দিয়েছে’।
সংবাদমাধ্যমগুলোতে দেয়া সাক্ষাতকারে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অনেকে বলেছে কোটা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তব্যের প্রতিবাদে তারা মধ্যরাতে বিক্ষোভ করেছে।
চীন সফর উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রবিবার বলেন, ”কোটা নিয়ে আদালত থেকে সমাধান না আসেলে সরকারের কিছু করার নেই।”
তিনি প্রশ্ন রাখেন, ”মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?”
সেই বক্তব্যের জের ধরে মধ্যরাতে বিক্ষোভ করতে শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর, সিলেটের শাহজালাল ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের জের ধরে তারা শ্লোগান দিতে থাকেন।
দুই হাজার আঠার সালে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলনের মুখে সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধাসহ সবরকম কোটা পদ্ধতি বাতিল করে একটি পরিপত্র জারি করেছিল সরকার।
সম্প্রতি সেই পরিপত্র বাতিল করে উচ্চ আদালতের রায়ের পর থেকে আন্দোলনে নামে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
এ মাসের শুরু থেকে টানা আন্দোলন ও বাংলা ব্লকেড নাম দিয়ে অবরোধের মতো কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে তারা। এ কর্মসূচির কারণে গত সপ্তাহে কয়েকদিন শহরে তীব্র যানজট তৈরি হয় এবং মানুষকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে।
ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে রবিবারই দিনের বেলায় আন্দোলনকারীরা বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতির বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে। এতে সংসদের অধিবেশন ডেকে কোটা সংস্কারের দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে সরকারকে চব্বিশ ঘণ্টার সময় বেঁধে দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা।
পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে করা সব মামলা এ সময়ের মধ্যে তুলে নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
আন্দোলনের সাথে জড়িত কয়েকজন ছাত্রলীগের হল পর্যায়ের নেতা সংগঠন থেকে পদত্যাগ করেছেন বলেও জানা গেছে।
কী হয়েছে ক্যাম্পাসগুলোতে
রবিবার রাত সাড়ে দশটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোর ভেতরে মিছিল শুরু হয়, যা পরে বিক্ষোভে রূপ নেয়। এক পর্যায়ে বিভিন্ন হল থেকে শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে এসে টিএসসি এলাকায় জড়ো হতে থাকে।
এক পর্যায়ে ছাত্রী হলগুলো থেকেও ছাত্রীরা বেরিয়ে এসে মিছিল সমাবেশে অংশ নেয়। মিছিল টিএসসি থেকে শাহবাগ এলাকা প্রদক্ষিণ করে। মিছিলকারীদের অনেকে হল থেকে নিয়ে থালা বাসন হাতে নিয়ে শ্লোগানের তালে তালে গলা মেলান।
পাশাপাশি হলগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকা ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও হলগুলোর গেইটে অবস্থান নেয়।
“মূলত প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যই সবাইকে ক্ষুব্ধ করেছে। সে কারণেই সব জায়গায় প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়েছে,” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জসিম উদ্দীন হলের একজন শিক্ষার্থী বলছিলেন বিবিসি বাংলাকে। হলে বাস করেন বলে তিনি তার নাম না প্রকাশ করার অনুরোধ করেছেন।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি হলে আটকে রাখার চেষ্টা এবং নেতাদের কয়েকজনের ওপর হামলারও খবর পাওয়া গেছে।
এদিকে শিক্ষার্থীদের মিছিল সমাবেশের মধ্যেই রাত বারটার দিকে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মধুর ক্যান্টিনে জমায়েত হতে থাকেন। টিএসসিসহ কয়েকটি এলাকাতেও সরকার সমর্থকদের উপস্থিতি দেখা যায় মধ্যরাতেই।
তবে শেষ পর্যন্ত আর তেমন কোন অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। রাত দেড়টার পর শিক্ষার্থীরা যার যার হলে ফিরতে শুরু করে।
এর মধ্যে বুয়েটের আন্দোলনকারীরাও মিছিল নিয়ে আসে টিএসসি এলাকায়। ওই এলাকা প্রদক্ষিণ করে তারা আবার তাদের ক্যাম্পাসে ফিরে যায়।
তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি জায়গায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের দু’ছাত্রকে আটকে রাখার খবরে উত্তেজনার শুরু হয়। পরে ক্যাম্পাসে মিছিল সমাবেশ চলাকালে রাত আড়াইটার দিকে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার খবর পাওয়া যায়।
রাত প্রায় তিনটা পর্যন্ত সেখানে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজ করছিলো বলে খবর পাওয়া গেছে।
প্রায় একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও। সেখানে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলায় কয়েকজন আহত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীর সামনে রাত বারটার পর এ ঘটনা ঘটে।
শেখ হাসিনা যা বলেছেন:
ঢাকায় রবিবারের সংবাদ সম্মেলনে ২০১৮ সালে কোটা বাতিল করার প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, “২০১৮ সালে আন্দোলনের সময় রাস্তায় ধংসাতœক কর্মসূচি, মানুষের ওপর হামলা, মিথ্যাচারসহ বিভিন্ন কারণে বিরক্ত হয়ে তখন কোটা বাতিল করে দিয়েছিলাম। আর এখন বিষয়টি আদালতের ওপর”।
তিনি বলেন, “বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। আদালত শিক্ষার্থীদের বলেছে তাদের বক্তব্য থাকলে তারা আদালতে গিয়ে বক্তব্য জানাক। যতক্ষণ পর্যন্ত আদালত থেকে সমাধান না আসবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের কিছু করার নেই”।
তাহলে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন কতদিন চলবে? কিংবা এই আন্দোলনের ভবিষ্যতও বা কী? এমন প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, “তারা আন্দোলন করছে করুক। কোন ধংসাতœক কাজ করতে পারবে না। পুলিশের গায়ে হাত দেয়া, গাড়ি ভাঙলে আইন তার নিজ গতিতে চলবে”।
শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কথা বলা হচ্ছে জানিয়ে শেখ হাসিনা প্রশ্ন তোলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার তাদের কে দিয়েছে? কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধার নাতি হিসেবে কোটায় ভর্তি হয়ে এখন কোটার বিরুদ্ধে কেন আন্দোলন করছে প্রশ্ন রাখেন শেখ হাসিনা।
তিনি প্রশ্ন রাখেন, সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি পুতিরা কোটা পাবে না তো রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?
তবে এই আন্দোলনে কোন মহল ইন্ধন দিচ্ছে কী না সেটি নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিল শেখ হাসিনার কাছে। তবে এর কোন জবাব তিনি দেন নি।
বিবিসি বাংলা