রাসেলের রক্তমাখা কাপড় হাতে কাঁদছেন মা অঞ্জনা। শুক্রবার নওগাঁর মান্দা উপজেলার কসবা ভোলাগাড়ি গ্রামে।
সমকাল
তাদের কেউ হারিয়েছেন ছেলে, কেউ বাবা। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের সময় ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া চারজনের পরিবারের সাম্প্রতিক দুর্দশার চিত্র উঠে এসেছে এ প্রতিবেদনে। নিহত ব্যক্তিদের সবাই বাড়ি ছেড়েছিলেন পরিবারের স্বপ্ন বাস্তবায়নে। কিন্তু সেই স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেছে গুলিতে।
কথা বলতে তাদের মানা
ছেলের শোকে কাতর শিরিনা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বারবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন। স্বামী নওশের আলী অসুস্থ অবস্থায় ভর্তি হয়েছেন হাসপাতালে। সংবাদকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি পরিবারের কেউ। প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, নওশের-শিরিনা দম্পতির বড় সন্তান ইমতিয়াজ হোসেন জাবির (২২) ঢাকার বনশ্রীতে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন ১৯ জুলাই। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৬ জুলাই বিকেলে মারা যান তিনি। সেখানে ময়নাতদন্ত শেষে রাতেই লাশ গ্রামের বাড়িতে আনা হয়।
শনিবার যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার হাজিরবাগ ইউনিয়নের দেউলি গ্রামের বাড়িতে তাঁর দাফন হয়। ওই গ্রামের ব্যবসায়ী নওশের আলীর ছেলে জাবির। ঢাকার সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ প্রথম বর্ষে অধ্যয়নরত এ তরুণ বনশ্রী এলাকার মেসে থাকতেন। তাঁর একমাত্র ছোট বোনটি পড়ছে অষ্টম শ্রেণিতে। স্বজন ও প্রতিবেশী সূত্র জানায়, ছেলের শোকে নওশের আলী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। পরিবারের সদস্যদের মানা করা হয়েছে সংবাদকর্মী বা কারও সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে। তারাও শোকের মধ্যে বাড়তি ঝামেলা নিতে চান না।
স্থানীয় বাসিন্দা সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মো. নুরুজ্জামান বলেন, জাবির অত্যন্ত ভালো ছেলে ছিল। বাজে সঙ্গ ওর ছিল না। ১৯ জুলাই জানতে পারেন, নামাজ পড়ে বের হওয়ার সময় তাঁর পায়ে গুলি লাগে। জাবিরের মৃত্যুতে এলাকাবাসী শোকাহত।
১৬ দিনেই লাশ হয়ে ফেরা
ফরিদা ইয়াসমিনের কান্না গত ১০ দিনেও থামেনি। ছেলে মাহমুদুল হাসানের শোকে বারবার তিনি মূর্ছা যাচ্ছেন নোয়াখালীর বাসায়। স্তব্ধ হয়ে পড়েছেন তাঁর বাবা এনজিও কর্মী জামাল উদ্দিন। জামাল-ফরিদা দম্পতি থাকেন শহরের বার্লিংটন মোড় এলাকায়। তাদের বাড়ি হাতিয়া পৌরসভার চরকৈলাশ মহল্লায়।
তিন ভাই-বোনের মধ্যে মাহমুদুল বড়। ছোট ভাইটি জেলা শহরের একটি বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণি ও বোন একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। সংঘর্ষের সময় ১৮ জুলাই রাজধানীর উত্তরায় মাথায় গুলি লেগে মারা যান মাহমুদুল। তাঁকে ঘিরে বড় স্বপ্ন ছিল পরিবারের।
লক্ষ্মীপুর পলিটেকনিক ইনিস্টিটিউট থেকে ইলেকট্রনিকস বিষয়ে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে চলতি মাসের শুরুতে ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্নশিপ শুরু করেন। ২ জুলাই তাঁকে উত্তরার রাজলক্ষ্মী এলাকার একটি মেসে তুলে দিয়ে যান মা ফরিদা। শুক্রবার বার্লিংটন মোড়ের বাড়িতে গেলে তিনি বলেন, ‘মাহমুদুল কোনো রাজনৈতিক দলে জড়িত ছিল না। ও রাজনীতি পছন্দ করত না। ছোটবেলা থেকেই ঝামেলা এড়িয়ে চলত। ছেলে আমাকে বলেছিল, ইন্টার্নশিপ শেষ করে চাকরি করবে, সংসারের হাল ধরবে। কিন্তু এক গুলিতেই আমার ছেলে ও পরিবারের সব স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেল।’
১৮ জুলাই দুপুর ১টার দিকে ছেলের সঙ্গে শেষ কথা হয় বাবা জামাল উদ্দিনের। মেসে মাছ-তরকারি শেষ হয়ে গেছে বলে জানান মাহমুদুল। আন্দোলনের কারণে তিন দিন বের হতে পারছিলেন না। বাবাকে বলেন, পরিস্থিতি ভালো থাকলে সন্ধ্যা বা রাতের দিকে বাসে করে নোয়াখালী চলে আসবেন। এর ৪-৫ ঘণ্টা পর মাহমুদুলের বন্ধু সায়েম হোসেন পরিবারকে ফোনে জানায়, মাহমুদুল অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে। জামাল বলেন, ‘আমরা ঢাকা ছুটে গিয়ে হাসপাতালে দেখি ছেলের লাশ।’
থমকে গেছে মায়ের চিকিৎসা
‘পাড়ার লোকেরা হামাক রাসেলের মা কয়া ডাকত। একন হামার ছাওয়াল তো আর নাই, হামিও নাই’ ছেলের রক্তমাখা কাপড় নিয়ে শুক্রবার বলছিলেন মো. রাসেলের (১৮) মা অঞ্জনা। নারায়ণগঞ্জের ডিআইটি রোডে ১৯ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে তিন দিন পর ঢামেকে মারা যান রাসেল। তাঁর বাড়ি নওগাঁর মান্দা উপজেলার কসবা ভোলাগাড়ি গ্রামে।
ওই এলাকার ভূমিহীন মো. পিন্টুর দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে সবার ছোট রাসেল। তাঁর আগের বোনটি শারীরিক প্রতিবন্ধী। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর বড় বোনও পরিবারের সঙ্গে থাকেন। এই পরিবারটি থাকে অন্যের জমিতে। পিন্টু অন্যের জমিতে কাজ করেন। তাঁর স্ত্রী অঞ্জনা নানা রোগে ভুগছেন। তাঁর চিকিৎসার জন্যই দুই বছর আগে নারায়ণগঞ্জের ডিআইটি রোড এলাকার একটি তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ নেন রাসেল। তাঁকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছেন পিন্টু। তিনি বলেন, ‘আমার নিজের বলতে কিছুই নাই। ছেলেকে কবর দিয়েছি মানুষের জমিতে। আমার আয় দিয়ে পরিবারের সবার মুখে ভাত দিতেই জীবন যায়-যায়। ভেবেছিলাম ছেলের পাঠানো টাকায় অসুস্থ বউয়ের চিকিৎসা করাব। তা আর হলো না। আমার সব শেষ হয়ে গেল।’
১৯ জুলাই দুপুরে ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে বুকে গুলিবিদ্ধ হন রাসেল। বিকেলে তাঁকে ঢামেক হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরদিন অস্ত্রোপচার করে গুলি বের করাও হয়। সোমবার মারা যান তিনি। মঙ্গলবার বাড়িতে লাশ পৌঁছানোর পর বুধবার দাফন হয়।
সাবেক ইউপি সদস্য পাঞ্জাব আলী বলেন, এই গ্রামে পিন্টুর চেয়ে গরিব লোক আর নেই। টাকার অভাবে কোনো ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া করাতে পারেননি। রাসেলই ছিল পরিবারের একমাত্র ভরসা। এখন তাদের ভিক্ষা করে খাওয়া ছাড়া অন্য উপায় নেই।
কে ধরবে সংসারের হাল
এক যুগ আগে ঢাকায় গিয়ে রিকশা চালানো শুরু করেন আবু ছায়েদ। বছর দুয়েক আগে মোহাম্মদপুরের বছিলার ৪০ ফিট এলাকায় দোকান ভাড়া নিয়ে পান বিক্রি শুরু করেন। ১৯ জুলাই জুমার নামাজের পর দোকানের জন্য ব্যাগ আনতে সড়কে বের হয়ে সংঘর্ষের মধ্যে পড়েন। গুলিবিদ্ধ হয়ে সড়কেই পড়ে ছিল আবু ছায়েদের নিথর দেহ। পরদিন প্রতিবেশীরা লাশ দাফনের জন্য পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া ইউনিয়নের প্রধানহাট গ্রামে পাঠিয়ে দেন। সেখানেই পারিবারিকভাবে দাফন হয় তাঁর লাশ।
রোববার সকালে আবু ছায়েদের বাড়িতে দেখা যায়, মাটি দেয়ালে ঘেরা বাড়ির জীর্ণ দুটি ঘরে থাকে তাঁর পরিবার। ভিটায় যে ১৫ শতক জমি আছে, তাও স্থানীয় কৃষি ব্যাংকে দায়বদ্ধ। সেখানেই মেয়ে শাহনাজ আক্তার ও ছেলে মামুন ইসলামকে নিয়ে থাকেন ছায়েদের স্ত্রী মাজেদা বেগম। স্বামীর পাঠানো টাকায় কোনোমতে সংসার চালাতেন তিনি।
মামুন ইসলাম বলেন, ‘ভিটেবাড়ি ব্যাংকে বন্ধক রেখে বাবা ৪৫ হাজার টাকা ঋণ নেন। সেই টাকায় ঢাকায় মুদি দোকান করতেন। আমাদের সম্পদ বলতে সেই ভিটেমাটিই। পরে শুনি সুদেআসলে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা হয়েছে। এ ঋণ নিয়েই আমরা দুশ্চিন্তায় ছিলাম। ঢাকায় সংঘর্ষের সময় গুলি বাবার মাথার এক পাশ দিয়ে ঢুকে আরেক পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়।’