আলজাজিরার সাক্ষাৎকারে প্রাপ্তি তাপসী
ছবি: সংগৃহীত
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে গোটা দেশে বিরাজ করছে এক অস্থির পরিস্থিতি। মাঝে কারফিউ দিয়ে সেনাবাহিনী নামিয়ে সরকার আন্দোলনকে দমানোর চেষ্টা করলেও ফের রাস্তায় নামতে শুরু করেছে ছাত্ররা। এবার ছাত্রদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে আরও অনেকে। সব মিলিয়ে টালমাটাল পরিস্থিতি। এই আন্দোলনে এরইমধ্যে নিহত হয়েছেন ২০০ এর বেশি মানুষ। এই হত্যাকাণ্ডের শাস্তি দাবি করে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন বাংলাদেশের সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হিসেবে কাতারভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আলজাজিরায় একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালযয়ের শিক্ষাথী প্রাপ্তি তাপসী। সেখানে তিনি স্পষ্ট করে জানিয়েছেন এই আন্দোলন আর কোটা সংস্কারে সীমাবদ্ধ নেই। এটা এখন গণমানুষের আন্দোলন। যারা স্বৈরাচার সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত তাদের এই আন্দোলন চালিয়ে যেতে প্রস্তুত।
কেন সবাই আন্দোলনে সেই প্রশ্নে প্রাপ্তি তাপসী জানান, ‘আমরা এখন রাস্তায়, কারণ আমাদের হাজারো ভাই-বোন মারা গেছেন, হাজারো মানুষকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়েছে। যার ফলে এখন, বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে, ছাত্রদের সঙ্গে কর্মজীবী মানুষ, সঙ্গীত ও অভিনয় শিল্পীরাও একাত্মতা পোষণ করেছেন। তারা সবাই রাস্তায় নেমে এসেছে, আন্দোলন করছে এবং একজন নাগরিক হিসেবে ও সাধারণ মানুষ হিসেবে তার অধিকার সম্পর্কে দাবি তুলছে।’
দেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে যুদ্ধ পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করে প্রাপ্তি বলেন, ‘মনে হচ্ছে আমার যুদ্ধের মধ্যে আছি। আমি আসলে জানি না এর জন্য পরবর্তীতে আমাকে কী করা হতে পারে। আমরা আসলে জানি না কখন এবং কোথা থেকে কেন ছাত্রদের তুলে নেওয়া হচ্ছে। এখানে কোনো বাক স্বাধীনতা নেই। আমরা কোনো আন্দোলন করতে পারছি না। ছাত্রদের অপহরণ করা হচ্ছে তাদের বাসা থেকে, খেলার মাঠ থেকে।’
প্রাপ্তি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনী ছাত্রদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে এই আন্দোলনের যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, আমাদের একজন সমন্বয়ক আরিফ সোহেলকে মিথ্যা মামলায় তুলে নেওয়া হয়েছে। ছাত্ররা রাস্তায় নামলেই তারা গণহারে গ্রেফতার করছে। রংপুরে আন্দোলন করার সময় অসংখ্য ছাত্রছাত্রীদের পুলিশ গ্রেফতার করেছে। তারা দিনদিন আরও কঠোর হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন যুদ্ধের মধ্যে আছি আমরা। বাস্তবে আমাদের এখানে কোনো যুদ্ধ চলছে না, তাহলে আমার প্রশ্ন যুদ্ধ আসলে কেমন হয়।’
বাংলাদেশ সরকার নিজেরাই আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সামাধান করতে পারে কিনা, নাকি তারা জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক কমিউনিটি থেকে কোনো সাহায্য প্রত্যাশা করছে, আলজাজিরার এমন প্রশ্নে প্রাপ্তি বলেন, ‘অবশ্যই না। সরকার এটির সমাধান করতে পারত রক্ত ঝরার আগেই। আমাদের ভাই ও বোনদের গুলি খেয়ে রক্ত ঝরার আগেই সমাধান করা উচিত ছিল তাদের। এটা এখন আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। সরকার হাজারের বেশি মানুষকে মেরেছে,হাজারের বেশি মানুষকে তুলে নিয়েছে। সব মিলিয়ে নয় হাজারের বেশি মানুষকে তুলে নিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং জেলে পাঠানো হয়েছে। কাজেই অবশ্যই আমরা বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ ও আন্দোলন কারিদের পক্ষ থেকে করজোড়ে প্রত্যেক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক কমিউনিটির কাছে সাহায্য চায়। তারা যেন সরকারকে প্রশ্ন করে, চাপ দেয়।’
সরকারের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নিপীড়ন তুলে ধরে প্রাপ্তি বলেন, ‘পুলিশ এখানে নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর গুলি চালিয়েছে, হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হয়েছে। বারান্দায় ও ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছে। আর এটা সম্পূর্ণ পরিকল্পিতভাবেই করা হয়েছে। আমরা আসলে জানি না কখন কাকে তুলে নেওয়া হবে। কতদিন আমরা মুক্ত জীবন কাটাতে পারব। ছাত্ররা বিশেষ করে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে মেরে ফেলা হচ্ছে। বাংলাদেশ পুলিশ, বর্ডার গার্ড, বাংলাদেশ আর্মি ও গোয়েন্দা বাহিনী সরকারের প্রতিটি বাহিনী নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালিয়েছে। কাজেই এটা এখন আর কোনো ইন্টারনাল ব্যাপার নেই। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক কমিউনিটিকে অবশ্যই এখন এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের সাহায্য করতে হবে। মানবতাকে সাহায্য করতে হবে।’
কোটা সংস্কার করে এরইমধ্যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। সেখানে ছাত্রদের দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। এরপরও কেন আন্দোলন করছে ছাত্ররা। এমন প্রশ্নে প্রাপ্তি বলেন, ‘আমাদের আন্দোলন এখন আর কোটায় সীমাবদ্ধ নেই। আমাদের হাজারো ভাই-বোন মারা গেছে। আমরা সেই নিহতের প্রকৃত সংখ্যাটি পর্যন্ত জানি না। সরকার বলছে তারা নিহতের সংখ্যা জানাবে। গণমাধ্যমে আমরা দেখছি আড়াইশর বেশি নিহতের কথা। বাংলাদেশি পুলিশ ও সরকারের বর্বরতা থেকে নিষ্পাপ শিশুরা পর্যন্ত রেহাই পাচ্ছে না। ২ বছর ৪, ৬ ও ১১ বছরের শিশুরা পর্যন্ত মারা গেছে। এমনকি শিশুদের পর্যন্ত আদালতে দাঁড় করিয়েছে তারা।’
প্রাপ্তি আরও বলেন, ‘কাজেই এই আন্দোলন এখন আর কোটায় সীমাবদ্ধ নেই। এই আন্দোলন এখন আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের আন্দোলন। এই আন্দোলন এখন আমাদের মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকারের আন্দোলন। শুরুতে এটা ছাত্রদের আন্দোলন হলেও এখন এটা গণমানুষের আন্দোলন। বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। আন্দোলন দমাতে সরকার অনেকেই গ্রেফতার করেছে। আমাদের অনেক নেতাকে তুলে নিয়ে গেছে। কিন্তু আমরা এখন বিশ্বাস করি আমরা এখন সবাই নেতা। আমার এখন সবাই সমন্বয়ক। আর আমরা এই লড়াই চালিয়ে যাব স্বৈরাচার শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত। এক নায়কতন্ত্র বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত এবং আমাদের সব দাবি না মেনে নেওয়া পর্যন্ত।’