আচমকা নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র নিয়ে মন্তব্য করে বেশ চাপে পড়েছেন তিনি। তাঁর এমন মন্তব্যে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে দূরত্ব প্রকাশ্যে চলে এসেছে। যদিও গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতির তরফ থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি না করার আহ্বান জানানো হয়েছে। তারপরও শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র প্রশ্নে বিতর্ক থামছে না।
মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন বলেছেন, ‘তিনি শুনেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন, কিন্তু তাঁর কাছে এ-সংক্রান্ত কোনো দালিলিক প্রমাণ বা নথিপত্র নেই।’ সাক্ষাৎকারটি পত্রিকাটির রাজনৈতিক ম্যাগাজিন সংস্করণ ‘জনতার চোখ’-এ প্রকাশিত হয়।
রাষ্ট্রপতির এমন মন্তব্যের পর দেশজুড়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা আলোচনা চলতে থাকে। রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ও ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের দাবিতে আজ মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৩টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গণজমায়েত কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এর আগে রাষ্ট্রপতির এই মন্তব্যকে রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল আখ্যায়িত করে তাঁর পদত্যাগের দাবিতে রাজশাহীতে বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছে ছাত্ররা।
এদিকে, সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, রাষ্ট্রপতি মিথ্যাচার করেছেন। তাঁর বক্তব্য শপথ লঙ্ঘনের শামিল। তিনি যদি তাঁর বক্তব্যে অটল থাকেন, তাহলে বিষয়টি উপদেষ্টা পরিষদে আলোচনা হতে পারে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘এর চেয়ে বড় মিথ্যাচার আর হতে পারে না। শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন, প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁর পাসপোর্ট বাতিল করেছে সরকার। এর পর পদত্যাগপত্রের কী প্রয়োজন আছে।’ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেছেন, সরকার গঠনের দুই মাস পরে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে রাষ্ট্রপতি এ কথা বলেছেন। রাষ্ট্রপতি অসত্য বলেছেন।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই রাষ্ট্রপতির অবস্থান নিয়ে নানা কথাবার্তা হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা প্রায়ই রাষ্ট্রপতিকে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ আখ্যা দিয়ে তাঁর অপসারণের দাবি জানিয়ে আসছেন। রাষ্ট্রপতির এই মন্তব্য জানাজানি হওয়ার পর অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ তৎক্ষণাৎ বলেছেন, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে শিগগির আন্দোলনের কর্মসূচি দেওয়া হবে।
এদিকে ছাত্র নেতাদের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও বার্তায় জানিয়েছেন, প্রয়োজনে বঙ্গভবন অভিমুখে লংমার্চ হবে।
জাতীয় নাগরিক কমিটির সূত্র জানিয়েছে, রাষ্ট্রপতির অপসারণের উপায় নিয়ে তাদের মধ্যে আলাপ চলছে। সরকারের মধ্যেও আলোচনা রয়েছে। রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে কে দায়িত্ব নেবেন– এমন প্রশ্নের জবাবে সূত্রটি জানিয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসই হতে পারেন রাষ্ট্রপতি। তাঁর নেতৃত্বে উপদেষ্টা পরিষদ সরকার পরিচালনা করবে।
ছাত্র নেতৃত্বের তাত্ত্বিক গুরু হিসেবে পরিচিত বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহার কয়েক দফায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মোঃ সাহাবুদ্দিনকে অপসারণের জন্য লিখেছেন। তিনিও মনে করেন ড. ইউনূসের রাষ্ট্রপতি হওয়া উচিত। বঙ্গভবন সূত্রও জানিয়েছে, পদত্যাগের জন্য রাষ্ট্রপতির ওপর চাপ বাড়ছে। বিশেষ উদ্দেশ্য পদত্যাগে বাধ্য করার পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।
বঙ্গভবনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি
বিভিন্ন মহলের ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার মুখে গতকাল সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতির কার্যালয় বঙ্গভবনের প্রেস উইং থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। উপ-প্রেস সচিব মুহা. শিপলু আমান স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ইস্যুতে রাষ্ট্রপতিকে উদ্ধৃত করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে যে প্রচারণা চালানো হয়েছে, তাতে জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। মীমাংসিত এই বিষয়ে নতুন করে কোনো বিতর্ক সৃস্টি করে অন্তর্বর্তী সরকারকে অস্থিতিশীল কিংবা বিব্রত করা থেকে বিরত থাকার জন্য রাষ্ট্রপতি সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।’
এতে আরও বলা হয়, ‘ছাত্র-জনতার গণবিপ্লবের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ও দেশত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেওয়া এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সাংবিধানিক বৈধতার ওপর যত প্রশ্ন জনমনে উদ্রেক হয়েছে তার সব প্রশ্নের উত্তর ৮ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আদেশে প্রতিফলিত হয়েছে। সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি মতামত চাওয়ার পর আপিল বিভাগ এই মতামত দিয়েছিলেন।’
আপিল বিভাগের মত
দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন এবং রাষ্ট্রপতি ৬ আগস্ট সংসদ ভেঙে দিয়েছেন। তাই সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেওয়া সম্ভব নয়। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সাংবিধানিক শূন্যতা পূরণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করতে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জনগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে আপিল বিভাগের মতামত চাওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানের বক্তব্য শোনা হয়েছে।
এ অবস্থায় সংবিধানে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কোনো বিধান না থাকায় উল্লিখিত প্রশ্নের বিষয়ে ১০৬ অনুচ্ছেদের উপদেষ্টামূলক এখতিয়ার প্রয়োগ করে আপিল বিভাগ মতামত দিচ্ছে যে, রাষ্ট্রের সাংবিধানিক শূন্যতা পূরণে জরুরি প্রয়োজনে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের নির্বাহী কার্য পরিচালনার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্যান্য উপদেষ্টা নিযুক্ত করতে পারবেন। রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্যান্য উপদেষ্টাকে শপথ পাঠ করাতে পারবেন।
সংবিধানে যা বলা আছে
সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের এখতিয়ার একমাত্র সংসদের। কিন্তু বর্তমানে সংসদ না থাকায় রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনা সংবিধানে নেই। তবে তিনি পদত্যাগ করতে পারেন স্পিকারের কাছে। বর্তমানে জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত এবং স্পিকার পদটি শূন্য। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার পর অজ্ঞাত স্থান থেকে পদত্যাগ করেছেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। আবার ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু হত্যা মামলায় কারাগারে রয়েছেন।
সংবিধানের ৫০(১) অনুচ্ছেদে বলা আছে, কার্যভার গ্রহণের তারিখ থেকে পাঁচ বছর মেয়াদে রাষ্ট্রপতি তাঁর পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন। শর্তাংশে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতির পদের মেয়াদ শেষ হওয়া সত্ত্বেও তাঁহার উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তিনি স্বীয় পদে বহাল থাকিবেন। ৫০(৩) অনুচ্ছেদে স্পিকারের উদ্দেশে স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে রাষ্ট্রপতি তাঁর পদ ত্যাগ করতে পারবেন।
৫২(১) অনুচ্ছেদে বলা আছে, এই সংবিধান লঙ্ঘন বা গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগে রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসিত করা যাবে। তার জন্য সংসদের মোট সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের স্বাক্ষরে অভিযোগের বিবরণ লিখিত একটি প্রস্তাবের নোটিশ স্পিকারের কাছে দিতে হবে। স্পিকারের কাছে নোটিশ দেওয়ার দিন থেকে ১৪ দিনের আগে বা ৩০ দিনের পর এই প্রস্তাব আলোচিত হতে পারবে না; এবং সংসদ অধিবেশনরত না থাকিলে স্পিকার অবিলম্বে সংসদ আহ্বান করবেন। ৫২(৪) অনুচ্ছেদে বলা আছে, অভিযোগ বিবেচনার পর মোট সদস্য সংখ্যার কমপক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে অভিযোগ যথার্থ বলে ঘোষণা করে সংসদ কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করলে প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার তারিখে রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হইবে।
তবে এর আগে একাধিকবার সংবিধান স্থগিত করে এবং সংবিধান বহাল রেখেও রাষ্ট্রপতি হওয়ার নজির রয়েছে।