দ্য ডিপ্লোম্যাটের প্রতিবেদন
শেখ হাসিনার সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির ৮ মাস পর প্রথমবারের মতো সরাসরি বৈঠক করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
ঐতিহাসিক বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় গত ৪ এপ্রিল থাইল্যান্ডের ব্যাংককে, ষষ্ঠ বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে।
বৈঠকটি নিঃসন্দেহে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ গত বছরের ৮ আগস্ট ড. ইউনূস অন্তর্বর্তী প্রশাসনের দায়িত্ব নেওয়ার পর এটিই ছিল প্রতিবেশী দুই নেতার প্রথম সরাসরি সাক্ষাৎ। আর এই বৈঠক হলো এমন এক সময়ে, যখন দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক দ্রুতই খারাপের দিকে যাচ্ছিল।
বৈঠকে কী আলোচনা হলো?
বৈঠকে উভয় পক্ষ তাদের মূল উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মোদি অভিযোগ করেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ হচ্ছে। আর ড. ইউনূস ফের হাসিনার প্রত্যর্পণের দাবি তোলেন।
বাংলাদেশ এই বৈঠককে ‘খুবই গঠনমূলক ও ফলপ্রসূ’ বলে আখ্যায়িত করে। অন্যদিকে ভারত জানায়, সব দ্বিপাক্ষিক ইস্যু আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের ওপর দুই নেতা একমত হয়েছেন।
তবে মূল অর্জন ছিল—বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হওয়াই। কারণ, এর আগে বাংলাদেশ বহুবার ভারতকে বৈঠকের অনুরোধ জানালেও তা উপেক্ষিত ছিল। তাই ব্যাংককের এই বৈঠককে অনেকে সম্পর্ক পুনর্গঠনের প্রথম ধাপ হিসেবে দেখছেন।
বাংলাদেশের ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের ভাষায়, ‘বহুল প্রতীক্ষিত এই বৈঠক বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের জন্য একটি ইতিবাচক সংকেত। আশা করা যায়, এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে সম্পর্ক উন্নয়নের পথ তৈরি হবে।’
কিন্তু সেই আশায় পানি ঢাললো ভারত নিজেই। ব্যাংকক বৈঠকের ঠিক তিন দিন পর ভারত ঘোষণা করে, ২০২০ সালে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করা হচ্ছে। এই সুবিধার ফলে বাংলাদেশ তার রপ্তানি পণ্য তৃতীয় দেশে পাঠাতে ভারতের স্থলবন্দর, বিমানবন্দর এবং সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে পারত।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল জানান, ভারতের বন্দর ও বিমানবন্দরে ‘চরম জট’ ও ব্যয়বৃদ্ধির কারণে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ভারতীয় রপ্তানিকারকদের অভিযোগ ছিল, বাংলাদেশের পণ্য পরিবহনের কারণে তাদের নিজস্ব রপ্তানিতে দেরি ও ক্ষতি হচ্ছে। তবে সিদ্ধান্তটি নেওয়ার সময়ের জন্য এতে কূটনৈতিক ইঙ্গিত রয়েছে বলেই ধারণা।
এদিকে ড. ইউনূস মার্চের শেষ সপ্তাহে চীন সফর করেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কোনো সমুদ্রপথ নেই। আমরাই এ অঞ্চলের একমাত্র সমুদ্র রক্ষক। এতে বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে চীনা অর্থনীতির বিস্তারের।’
তার এই বক্তব্য দিল্লিকে স্পষ্ট বার্তা দেয়। ভারতের জন্য স্পর্শকাতর সিলিগুঁড়ি করিডোর খুব কাছেই, যা ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে উত্তর-পূর্বের একমাত্র সংযোগপথ। এই করিডোরের আশপাশে রয়েছে বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, এমনকি চীনের অবস্থানও।
এমন অবস্থানে দাঁড়িয়ে চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতার বার্তা দেওয়া ছিল ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগে আঘাত করার মতো। চীনপন্থি এই অবস্থান হয়তো ইউনূসকে তাৎক্ষণিক কূটনৈতিক সুবিধা এনে দেয়।
অনেকেই মনে করেন, ইউনূসের চীন সফরের কূটনৈতিক চাপেই মোদি বৈঠকে বসতে বাধ্য হন। তবে ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল সেই প্রাথমিক সাফল্যে বড় ধাক্কা দেয়।
ভারতের এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঘোষণা আসে— বাংলাদেশ থেকে আমদানি পণ্যে ৩৭ শতাংশ ‘পাল্টা’ শুল্ক বসানো হবে। যদিও ৯০ দিনের জন্য সেটি স্থগিত রয়েছে। তবুও তাতে বাংলাদেশের অর্থনীতি গভীর অনিশ্চয়তায় পড়েছে।
অন্যদিকে ভারতের বন্দর ব্যবহারের সুযোগ বন্ধ হওয়ায় বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব ইস্ট এশিয়া, মধ্য এশিয়া ও ইউরোপে রপ্তানি বাণিজ্যে মারাত্মক প্রভাব পড়বে। তাদের এহেন সিদ্ধান্তের ফলে পরিবহণ খরচ বাড়বে, সময় লাগবে বেশি এবং ঝুঁকিও বাড়বে। এর ফলে অনেক গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে পড়তে পারে। বেকার হয়ে যেতে পারেন লাখ লাখ শ্রমিক।
তাই ব্যাংককের হাস্যোজ্জ্বল করমর্দনের আড়ালেও বাংলাদেশের জন্য এই পর্বটা শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠল কূটনৈতিক চাপে ভরা এক কঠিন সময়। ড. ইউনূস হয়তো বেইজিংয়ে বাহবা কুড়িয়েছেন। তবে তার কিছু মন্তব্যই হয়তো ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।