Views: 1
ষ্টাফ রির্পোটার
গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা হারানোর তিন মাস পরও নিজের কর্মের জন্য আওয়ামী লীগে অনুশোচনা দেখা যাচ্ছে না। বরং পুরো বিষয়টি ‘ষড়যন্ত্র’ বলে মনে করে দলটি। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান সরকার ব্যর্থ হলেও জনগণের কাছে ক্ষমা না চাইলে মাঠের রাজনীতিতে ফেরা আওয়ামী লীগের জন্য কঠিন হবে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলন দমনে যেভাবে শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে এবং তাতে যত প্রাণহানি হয়েছে, তার দায় স্বীকার করে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেনি আওয়ামী লীগ। দলটির শীর্ষ নেতারা এখনও বিশ্বাস করেন, গণঅভ্যুত্থানের নামে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে উৎখাত করে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। একই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে শেখ হাসিনাসহ দলের নেতাকর্মীর নামে মামলা দিয়ে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো ও আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তোলা হচ্ছে।
এসবের মধ্যে দলটি আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে উল্লেখ করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, এখনই সরকারবিরোধী আন্দোলনে নামার পরিকল্পনা আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে নেই। বরং দ্রব্যমূল্য, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে হতাশা ও অসন্তোষ দেখা যাচ্ছে, সামনে তা আরও বেড়ে অন্তর্বর্তী সরকার কতদিনে জনসমর্থন হারায়, সেটি দেখার অপেক্ষা করছেন তারা।
‘পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র’তত্ত্ব
সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানকে শুরু থেকেই ‘পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র’ বলে আসছে আওয়ামী লীগ। গত জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে দেশে সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাই প্রথম ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করেন। গত ২৪ জুলাই তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটা যে একটা বিরাট চক্রান্ত– সেটা বোঝাই যাচ্ছিল’।
ক্ষমতা হারানোর তিন মাস পরও আওয়ামী লীগ একই কথা বলছে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘এটা (গণঅভ্যুত্থান) যে একটা পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ছিল, ইউনূস সরকারের কথাবার্তা ও কাজকর্মেই সেটি ক্রমেই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিজেও সে কথা স্বীকার করেছেন।’
আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সরকারবিরোধী রূপ নেওয়ার ক্ষেত্রে বিএনপি-জামায়াতের পাশাপাশি বিদেশি শক্তির ভূমিকা রয়েছে। সাবেক নৌপ্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যারা বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছে, তারাই এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশকে তারা ব্যর্থ রাষ্ট্র প্রমাণ করতে চায়।’ শেখ হাসিনাসহ অন্য নেতাদের বিচার করার উদ্যোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এগুলো সবই ষড়যন্ত্রের অংশ। আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যেই এসব করা হচ্ছে। অতীতেও এমন চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু কেউ আওয়ামী লীগকে দাবাতে পারেনি, এরাও পারবে না।’
জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে হতাহতের ঘটনার পুরো দায় নিতে চায় না আওয়ামী লীগ। বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘শুরু থেকেই আমরা বলে আসছি, এই আন্দোলনে একটা তৃতীয়পক্ষ রয়েছে, যাদের গুলিতে সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘সরকারের একজন উপদেষ্টাও (সাবেক স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন) তো এ কথা স্বীকার করেছেন, সেভেন পয়েন্ট সিক্স টু রাইফেল বাংলাদেশ পুলিশ ব্যবহার করে না। অথচ সেই অস্ত্র দিয়ে সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালানো হয়েছে।’
‘কিছু ভুলত্রুটি তো ছিলই’
টানা দেড় দশক ক্ষমতায় থাকাকালে কিছু ভুল করার কথা স্বীকার করছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘আওয়ামী লীগ তো আসমান থেকে আসা কোনো দল নয়। আমরা সবাই মানুষ। কাজেই দেশ পরিচালনার সময় কিছু ভুল হওয়া স্বাভাবিক। কিছু ভুলত্রুটি তো ছিলই।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এখন আত্মসমালোচনা করছি। যেসব ভুল করেছি, সেগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগোতে চাই।’
অনিয়ম-দুর্নীতি, জমি দখল, অর্থ পাচারের মতো অপরাধ প্রসঙ্গে বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, আওয়ামী লীগ সবসময় এগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে ছিল, থাকবে। কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সেটা দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
‘আত্মগোপনে যেতে বাধ্য করা হয়েছে’
ক্ষমতা ছেড়ে শেখ হাসিনা ভারত চলে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা দিশেহারা হয়ে পড়েন। বিভিন্ন স্থানে দলটির কার্যালয়, নেতাকর্মীর বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা ঘটতে থাকে। ফলে জীবন বাঁচাতে আত্মগোপনে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না বলে জানান আওয়ামী লীগ নেতারা। বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘আমাদের আত্মগোপনে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। যেভাবে হামলা ও হত্যা শুরু হয়েছিল, তাতে আত্মগোপনে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।’ খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আমাদের নেত্রীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বানোয়াট ও ভিত্তিহীন মামলা দেওয়া হয়েছে। গত চার মাসে হামলায় আওয়ামী লীগের কয়েকশ নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। ইতোমধ্যে আমরা আহত-নিহতদের তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছি।
বিপর্যয় কাটানোর চেষ্টা
বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগ। দেশ-বিদেশে আত্মগোপনে থাকা নেতাদের মধ্যে যোগাযোগের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। দলের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ ও এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডেলেও আওয়ামী লীগকে বেশ সক্রিয় দেখা যাচ্ছে। এমনকি তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে শেখ হাসিনার একাধিক ফোনালাপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে। যদিও সেগুলো আসল কিনা, তা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘শুধু নেতাদের সঙ্গেই না, সাধারণ কর্মী ও মানুষের সঙ্গেও আমাদের নেত্রীর যোগাযোগ রয়েছে। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি আলাপ-আলোচনা করছেন এবং নির্দেশনা দিচ্ছেন।’
সামনের পরিকল্পনা কী
দলকে সংগঠিত করাই এখন আওয়ামী লীগের মূল লক্ষ্য। বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘এ সরকার আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিস্ট বলে। অথচ তারা নিজেরা যে সবচেয়ে বড় ফ্যাসিস্ট, মানুষ সেটি দেখেছে। দেখেছে, কীভাবে আমাদের কর্মীদের ওপর হামলা হয়েছে।’ তবে আপাতত সরকারবিরোধী বড় কর্মসূচিতে যাওয়ার পরিকল্পনা নেই বলে ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি বিবেচনায় গণমানুষের জন্য যে ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন, সেটাই করব।’ কিন্তু নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে থাকলে কর্মসূচি কীভাবে সফল হবে– এমন প্রশ্নে খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লীগ কর্মীনির্ভর রাজনৈতিক দল। ফলে কে নেতা বা তারা কোথায়, সেটা বড় কথা নয়।
বিশ্লেষকরা যা বলছেন
ভুল স্বীকার করে ক্ষমা না চাইলে রাজনীতির মাঠে ফেরা আওয়ামী লীগের জন্য কঠিন হবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এ প্রসঙ্গে ড. জোবাইদা নাসরিন বলেন, রাজনীতিতে ফিরে আসতে হলে আওয়ামী লীগকে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়েই আসতে হবে। আর সেজন্য কর্তৃত্ববাদী শাসনের চালানোর জন্য ভুক্তভোগী সাধারণ জনগণের কাছে আওয়ামী লীগের ক্ষমা চাওয়া উচিত।
একই অভিমত দিয়ে মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ক্ষমা চাইলে তো এদেশের মানুষ ক্ষমা করে দেয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ এখনও ক্ষমা চায়নি এবং চাইবে বলেও মনে হচ্ছে না। কারণ ক্ষমা চাইলে তাদের রাজনীতি আর থাকে না।
সংগৃহিত