যাত্রা শুরুর পর এবারই প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। একসময়ের ঐতিহ্যবাহী সংগঠনটি এখন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দায়ে নিষিদ্ধ। জন্মের ৭৬ বছরের ইতিহাসে অনেক বিরল অর্জন সত্ত্বেও গত দেড় দশকে নানা বিতর্কে জড়িয়েছে সংগঠনটি। বিশেষ করে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বেপরোয়া হামলা তাদের ভাবমূর্তি তলানিতে ঠেকিয়েছে; জুটেছে নিষিদ্ধ সংগঠনের তকমা।
আজ ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন হলেও তার জন্মের আগেই যাত্রা শুরু করে ছাত্রলীগ। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে এর জন্ম। এর পর বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এ সংগঠনের নেতাকর্মীর অনন্য ভূমিকা ছিল। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও ছাত্রলীগ ছিল সামনের সারিতে। কিন্তু সেই ছাত্রলীগই পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত হয়। চব্বিশের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে যমদূত হিসেবে আবির্ভূত হন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা।
ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। এরই ধারাবাহিকতায় ২৩ অক্টোবর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এর পর থেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সংগঠনটির নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করতে থাকে। তবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দায়ে এ সংগঠনের কোনো নেতাকর্মীকে এখনও বিচারের মুখোমুখি করার খবর পাওয়া যায়নি।
২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষকতায় ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হতো ব্যাপক আড়ম্বরের সঙ্গে। কিন্তু গতকাল শুক্রবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে চোখমুখ বেঁধে ঝটিকা মিছিল, দেয়াল লিখন, গ্রাফিতি অঙ্কনের তৎপরতা চালাতে দেখা গেছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগঠনটির বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে আটকের খবর মিলেছে।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এস এন মো. নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ছাত্রলীগ রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ। কোনো নিষিদ্ধ সংগঠনের প্রকাশ্যে কার্যক্রম চালানোর সুযোগ নেই। পুলিশ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। তারা কোনোভাবেই মাঠে নামতে পারবে না।
মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে চলে যান। কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকও রয়েছেন অজ্ঞাত স্থানে। তবে সংগঠনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত, ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল ছাত্রলীগের সভাপতি কাজল দাসসহ সারাদেশে ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ ছাড়া অনেক নেতাকর্মীর ছাত্রত্ব ও সনদ বাতিল করা হয়েছে। পরীক্ষা দিতে গিয়ে গণপিটুনি দিয়ে তাদের পুলিশেও সোপর্দ করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এ অবস্থায় গোপনেই নিজেদের কার্যক্রম চালাচ্ছে সংগঠনটি।
ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, তারা এখন আত্মগোপনে আছেন। কেউই এলাকায় যেতে পারছেন না। ভয়ে অনেকে একাডেমিক কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছেন না। অনেকে বিদেশে যাওয়ার পরিকল্পনা করলেও মামলা এবং গ্রেপ্তার আতঙ্কে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম চালাতে পারছেন না।
ছাত্রলীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ ঘেঁটে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে কোনো ধরনের কর্মসূচি দেওয়া হয়নি। তবে পেজ থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংগঠনের নেতাকর্মীকে ঝটিকা মিছিল, দেয়াল লিখন এবং গ্রাফিতি অঙ্কনের ভিডিও ও ছবি শেয়ার করা হয়েছে। এমনকি দেশের বাইরেও দেয়াল লিখন কর্মসূচি পালন করেছেন নেতাকর্মীরা। ঝটিকা মিছিলগুলোতে হাতেগোনা কয়েকজন নেতাকর্মী মুখ ঢেকে স্লোগান দিচ্ছিলেন।
ভিডিও ও ছবি বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৪ জানুয়ারি উপলক্ষে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগ, বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগ এবং মুন্সীগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগ ঝটিকা মিছিল করেছে। অন্যদিকে, দেয়াল লিখন ও গ্রাফিতি করেছে কুড়িগ্রাম জেলা ছাত্রলীগ, জামালপুর জেলা ছাত্রলীগ, পটুয়াখালী জেলা ছাত্রলীগ, রাজশাহী জেলার বাঘা উপজেলা, পিরোজপুর জেলার ভাণ্ডারিয়া উপজেলা ছাত্রলীগ, ঢাকা জেলার ভাটারা থানা ছাত্রলীগ এবং পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা উপজেলা ছাত্রলীগ। দেশের বাইরে ইতালি শাখা ছাত্রলীগ দেয়াল লিখন কর্মসূচি পালন করে।
সূত্র জানায়, ছাত্রলীগ নেতাদের রাজধানীর ধানমন্ডি, মিরপুরসহ বিভিন্ন স্থানে থাকার খবর পাওয়া গেলেও গ্রেপ্তার হচ্ছেন কমই। তবে তারা ফেসবুকে অনেকটাই সরব। একাধিক নেতাকর্মী জানান, বিপদের সময় তারা শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাচ্ছেন না। তারা দেশে বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। অন্যদিকে জানা গেছে, ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ইনানসহ শীর্ষ নেতাদের অনেকেই ইতোমধ্যে দেশ ছেড়েছেন। গত ৬ আগস্ট বিমানবন্দরে আটকা পড়েন ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রিয়াজ মাহমুদ। তিনিও বর্ডার পাড়ি দিয়ে পালিয়েছেন বলে জানা গেছে।
নেত্রকোনা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, গতকাল শুক্রবার সকালে নেত্রকোনা জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কৌশিক রায়ের নেতৃত্বে ঝটিকা মিছিল হয়েছে। নেত্রকোনা জেলা শহরের ছোট বাজারের আওয়ামী লীগ দলীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে এ মিছিল বের হয়। এ ঘটনায় নেত্রকোনা সদর থানার এসআই আকামল হোসেন বাদী হয়ে ছয়জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত সংখ্যক আসামি করে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করেন। পুলিশ ছাত্রলীগের ছয় নেতাকর্মীকে আটক করে। তাদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
আটকরা হলেন– নেত্রকোনা জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি ও নাগড়া (বাড়ইপাড়া) এলাকার বাবুল সরকারের ছেলে চিন্ময় সরকার, জেলা ছাত্রলীগের সহক্রীড়া সম্পাদক ও বড়বাজারের সজল সরকারের ছেলে সন্দীপ সরকার, নেত্রকোনা পৌর ছাত্রলীগের সাবেক তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক এবং বড়বাজারের দুর্গাচরণ সাহার ছেলে জয় সাহা, জেলা ছাত্রলীগের সদস্য ও বড়বাজারের মৃত রাখাল চন্দ্র বণিকের ছেলে সিন্ধ বণিক বিশাল, নেত্রকোনা পৌর ছাত্রলীগের সদস্য ও বড়বাজারের কৃষ্ণ রায়ের ছেলে রাহুল রায় এবং জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য ও বারহাট্টার নৈহাটী গ্রামের আজিজুল হকের ছেলে লোকমান হোসেন।
নেত্রকোনা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী শাহ্ নেওয়াজ জানান, কয়েকজন মিলে শুক্রবার ভোরে ঝটিকা মিছিল বের করে। এ ঘটনায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা হয়েছে। ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
সভাপতির ভিডিও বার্তা
গতকাল শুক্রবার এক ভিডিও বার্তায় সংগঠনের সর্বশেষ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন অভিযোগ করেন, ছাত্রলীগকে অন্যায়ভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সংগঠনের নেতাকর্মীরা শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
সংগৃহিত