অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে লন্ডনে তারেক রহমানের বৈঠকের পর আপাতদৃষ্টিতে ‘নির্বাচন কেন্দ্রিক সংকট উত্তরণ’ করা গেছে মনে হলেও সত্যিকার অর্থেই সে সংকট কতটা দূর হয়েছে তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে রাজনৈতিক মহলে। রাজনৈতিক নেতা ও বিশ্লেষকদের ধারণা, প্রকৃত অর্থে রাজনৈতিক জটিলতা এখনো কাটেনি, বরং সামনের সময়টায় ‘রাজনৈতিক মেরুকরণ আরও জটিল’ হয়ে উঠতে পারে বলেও বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন। বিবিসি বাংলার রাকিব হাসনাতের প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে।
বৈঠকের পর কেবলমাত্র নির্বাচন কেন্দ্রিক সময়সীমার বিষয়ে আলোকপাত করেছে সরকার এবং বিএনপি। তবে বৈঠকের সম্ভাব্য ফলাফল, রাজনীতিতে এর তাৎপর্য এবং অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া – এমন নানা বিষয় নিয়ে এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে আলোচনা চলছে।
বৈঠক নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায়, জামায়াতে ইসলামী অভিযোগ করেছে, বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করে সরকার যেভাবে ব্রিফিং ও বিবৃতি দিয়ে বৈঠকের বিষয়বস্তু প্রকাশ করেছে তাতে ‘একটি বিশেষ দলের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা, যা তার নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ণ করেছে’।
অন্যদিকে, নতুন দল এনসিপি এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘জুলাই সনদ’ কার্যকর করা ও বিচারের রোডম্যাপ ঘোষণার পরই নির্বাচন-সংক্রান্ত আলোচনা চূড়ান্ত হওয়া উচিত।
দলটির সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলছেন, তারা আশা করছেন, বিএনপি এখন এই দুই ইস্যুতে সহযোগিতা করবে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলছেন, পর্দার আড়ালে এমন কিছু নেগোসিয়েশন হয়েছে যাতে বিএনপিকে কিছু ছাড় দিতে হয়েছে। তবে দুই নেতার দেড় ঘণ্টার বৈঠকে নির্বাচনের তারিখ চূড়ান্ত করা গেলো না কেন- সেই প্রশ্নও করছেন কেউ কেউ।
এছাড়া নির্বাচন ছাড়াও সরকারের তিন উপদেষ্টাদের পদত্যাগ ও দলীয় নেতা ইশরাক হোসেনের মেয়র হিসেবে শপথের দাবিতে সরকারকে বিএনপি ছাড় দিলো কী-না কিংবা এ দুটি বিষয়ে দলটির অবস্থান এখন কী হবে তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
আগের দাবি নিয়ে কি বিএনপি এখন নমনীয়?
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে লন্ডনে শুক্রবার বৈঠক করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ওই বৈঠকের মাধ্যমে বিএনপির একক নেতা হিসেবে তারেক রহমানের একটি আনুষ্ঠানিক শো-ডাউন হয়ে গেলো বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক।
অন্যদিকে, বৈঠকের আগে তারেক রহমানকে স্বাগত জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান।
আবার বৈঠকের পর যে যৌথ ব্রিফিং হয়েছে তাতে খলিলুর রহমানের সঙ্গেই উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
যদিও কয়েক সপ্তাহ আগেই রাখাইনের জন্য মানবিক করিডর ইস্যুতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সরকারের দূরত্ব তৈরির দায়ে খলিলুর রহমানকে অভিযুক্ত করে তার পদত্যাগ চেয়েছিল বিএনপি।
সেসময় প্রধান উপদেষ্টার সাথে ঢাকায় বিএনপির নেতাদের সর্বশেষ বৈঠকে দলটি খলিলুর রহমান ছাড়াও সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ এবং মাহফুজ আলমের পদত্যাগের জোর দাবি করেছিল।
একইসঙ্গে, আদালতের রায়ের পর ঢাকা দক্ষিণের মেয়র পদে শপথের জন্য দিনের পর দিন রাস্তা বন্ধ করে আন্দোলন করেছেন ইশরাক হোসেন ও তার সমর্থকরা।
মূলত এসব ঘটনাপ্রবাহকে কেন্দ্র করেই সরকারের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের অবনতি হয়েছিল এবং তার জের ধরে প্রধান উপদেষ্টার ‘কথিত পদত্যাগে’র গুঞ্জনও ছড়িয়ে পড়েছিল কয়েক সপ্তাহ আগে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলছেন, লন্ডনের বৈঠকে আলোচনায় না আসলেও এসব দাবি তাদের এখনো আছে।
‘সরকারের নিরপেক্ষতার স্বার্থে আমরা দাবিগুলো করেছিলাম। সরকারের উচিত নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা।’
দলটির সিনিয়র নেতাদের একজন ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলছেন, লন্ডন বৈঠকের বিস্তারিত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যখন দলের সভায় জানাবেন, তখন এসব বিষয়ে করনীয় সম্পর্কে তারা আলোচনা করবেন।
‘এখনো আমরা বিস্তারিত জানি না। অন্য সব দাবি এখনো বহাল আছে। দলের সভায় সবকিছু নিয়ে আলোচনা হবে’
বৈঠকে নির্বাচনই কি আলোচ্য ছিল?
বিএনপি সাম্প্রতিক সময়ে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনের জন্য শক্ত অবস্থান প্রকাশ করে আসছিল। শুক্রবার তারেক-ইউনূস বৈঠকের পর যে যৌথ বিবৃতি দেয়া হয়েছে, সেখানেও শুধু নির্বাচন প্রসঙ্গই গুরুত্ব পেয়েছে।
তবে এতে বলা হয়েছে, ২০২৬ সালের রমজানের আগেই বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। এক্ষেত্রে অবশ্য ওই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে বিবিসি যে ধারণা পেয়েছে, তাতে বুঝা যায় শুধু নির্বাচন নয়, বরং নির্বাচনের পর বিএনপি ক্ষমতায় গেলে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ডের বৈধতা দেওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে সেখানে আলোচনা হয়েছে।
বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদও বলছেন যে, নির্বাচন ও ভবিষ্যতমুখী অর্থাৎ নির্বাচন পরবর্তী বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে ওই বৈঠকে। যদিও তিনি বিস্তারিত কিছু বলেননি।
দলীয় সূত্রগুলো বলছে, এই বৈঠকে নির্বাচন পরবর্তী বিষয়গুলোতে দুই পক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতার চেষ্টা চালিয়েছে মধ্যস্থতাকারীরা, যেখানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে পরবর্তী সংসদে সরকারের বৈধতা নিশ্চিত করা। যদিও এ বিষয়ে সমঝোতা কতটা হয়েছে তা এখনো অনিশ্চিত।
বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে বেশ কিছু ঘটনা ‘ফৌজদারি আইনে’ অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে – এমন বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা কিংবা কোন ঐকমত্য হয়েছে কী-না তা জানা যায়নি।
অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে গত অক্টোবরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছিলো ‘১৫ই জুলাই থেকে আটই অগাস্ট পর্যন্ত সংগঠিত গণঅভ্যুত্থান সংশ্লিষ্ট ঘটনার জন্য কোনো মামলা, গ্রেফতার বা হয়রানি করা হবে না’।
প্রসঙ্গত, অগাস্ট মাসে আন্দোলন চলার সময় সিরাজগঞ্জে তের জন পুলিশসহ মোট ৪৪ জন পুলিশ হত্যার ঘটনা ঘটেছিলো। যদিও আইনজীবীরা তখন বলেছিলেন যে, ফৌজদারি অপরাধ থেকে কাউকে দায়মুক্তি দেয়ার সুযোগ নেই।
রাজনীতিতে ওই বৈঠকের প্রভাব
বিএনপি নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলছেন, এ বৈঠকের মধ্য দিয়ে নির্বাচন নিয়ে যে দুশ্চিন্তা মানুষের মধ্যে ছিল, তা কেটে গেছে এবং এর ফলে সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত হয়েছে।
বিশ্লেষকরা কেউ কেউ মনে করেন নির্বাচন নিয়ে জামায়াত ও এনসিপি আরও সময় নেওয়ার পক্ষপাতী। এর বিপরীতে বিএনপি চায় দ্রুত নির্বাচন। পাশাপাশি কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকলেও আওয়ামী লীগ চায় ‘ইউনূস সরকারের দ্রুত বিদায়’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার শিক্ষক মোহাম্মদ সাইফুল আলম চৌধুরী বলছেন, তারেক-ইউনূস বৈঠকের গুরুত্বপূর্ণ ফল হলো সরকার ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতা এবং এর ফলে বিএনপির আর রাস্তায় আন্দোলনে নামার সুযোগ থাকলো না।
‘একদিকে বিএনপির নেতৃত্ব তারেক রহমানের হাতে, এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অন্যদিকে সরকার নিশ্চয়তা পেয়েছে বিএনপি রাস্তায় নামছে না।’
আরেক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক সাব্বির আহমেদ বলেন, দ্রুত নির্বাচনই বিএনপির জন্য বড় বিষয় এবং সে কারণেই তারা হয়তো কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ছাড় দিয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
‘একটা সমঝোতার জায়গা তৈরি হয়েছে। কিছু ইস্যু নিয়ে দ্বন্দ্ব হয়েছিলো। হয়তো দুপক্ষই কিছু জায়গায় ছাড় দিয়েছে। ফলে রাজনীতির ক্ষেত্রে বড় প্রভাব হলো- আগামী মাসগুলোতে নির্বাচনের কাঙ্ক্ষিত রোডম্যাপ পেয়ে গেলে বিএনপি নীরব থাকবে এবং সরকারকেও কোনো সংকটে পড়তে হবে না’।
এদিকে জামায়াতে ইসলামী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যকার বৈঠকের বিষয়বস্তু যেভাবে ব্রিফিং ও যৌথ বিবৃতিতে প্রকাশ করা হয়েছে তাতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।
শনিবার দলটির এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গত ছয়ই জুন জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেন।
তার এই ঘোষণার পর লন্ডন সফরকালে একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে বিদেশে যৌথ প্রেস ব্রিফিং এবং বৈঠকের বিষয় সম্পর্কে যৌথ বিবৃতি প্রদান করা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ব্যত্যয় বলে আমরা মনে করি।’
‘এর মাধ্যমে তিনি একটি দলের প্রতি বিশেষ অনুরাগ প্রকাশ করেছেন, যা তার নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ণ করেছে। আমরা মনে করি দেশে ফিরে এসে প্রধান উপদেষ্টার অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করে এ ব্যাপারে তার অভিমত প্রকাশ করাই সমীচীন ছিল,’ জামায়াতের বিবৃতিতে বলা হয়েছে।
এদিকে, অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের দল এনসিপির যুগ্ম আহবায়ক আরিফুল হক আদীব বলছেন, এর আগে দুই দফায় জুলাই সনদ ঘোষণার কথা বলেও সরকার করতে পারেনি।
প্রধান উপদেষ্টা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের যে কথা বলেছেন, সেখানেও আগে এ দুটি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে। আমরা আশা করি বিএনপি এখন এতে সহযোগিতা করবে।’
তথ্যসুত্রঃ যুগান্তর