নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ৭ খুনের ঘটনায় ১১ বছর পূর্ণ হলো আজ। ১১ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও এই হত্যাকাণ্ডের বিচার কার্যক্রম শেষ হয়নি। ৮ বছর আগে নিম্ন আদালত এবং ৭ বছর আগে উচ্চ আদালত রায় ঘোষণা করলেও মামলাটি আপিল বিভাগে ঝুলে রয়েছে। বর্তমানে রায় কার্যকরের অপেক্ষায় রয়েছেন স্বজনরা। তাদের একটাই আশা, রায় কার্যকর হয়েছে সেটা যেন শুনতে পান।
এদিকে রায়ের ধীরগতির কারণে এখনো ভয় ও আতঙ্কে রয়েছেন নিহতের পরিবারের সদস্যরা। সেইসঙ্গে বিভিন্ন সময়ে সাহায্য সহযোগিতার ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে নানাভাবে আশ্বাস দেওয়া হলেও বাস্তবে তা না হওয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন ভুক্তভোগী অধিকাংশ পরিবারগুলো।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বহুল আলোচিত নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলাটির গত ১১ বছরে বিচারের দুটি ধাপ শেষ হয়েছে। সবশেষ ২০১৮ সালের ২২ আগস্ট ৩৫ আসামির মধ্যে ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১১ জনকে যাবজ্জীবন এবং ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন উচ্চ আদালত। মামলাটি এখন চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য অপেক্ষায় রয়েছে।
হাইকোর্টে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা ১৫ আসামি হলেন, র্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ, সাবেক দুই কোম্পানি কমান্ডার মেজর (অব.) আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার (চাকরিচ্যুত) এম মাসুদ রানা, নাসিকের সাবেক কাউন্সিলর ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি নূর হোসেন, ল্যান্সনায়েক বেলাল হোসেন, হাবিলদার মো. এমদাদুল হক, আরওজি-১ মো. আরিফ হোসেন, ল্যান্সনায়েক হিরা মিয়া, সিপাহি আবু তৈয়ব আলী, কনস্টেবল মো. শিহাব উদ্দিন, এসআই পূর্ণেন্দু বালা, সৈনিক আবদুল আলিম, সৈনিক মহিউদ্দিন মুনশি, সৈনিক আল আমিন ও সৈনিক তাজুল ইসলাম।
মৃত্যুদণ্ড পরিবর্তন হয়ে যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত ১১ আসামি হলেন, সৈনিক আসাদুজ্জামান নূর, সার্জেন্ট এনামুল কবির, নূর হোসেনের সহযোগী আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান, রহম আলী, আবুল বাশার, মোর্তুজা জামান, সেলিম, সানাউল্লাহ, শাহজাহান ও জামালউদ্দিন।
এদের মধ্যে পাঁচ আসামি পলাতক রয়েছেন। তারা হলেন- মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সৈনিক মহিউদ্দিন মুনশি, সৈনিক আল আমিন ও সৈনিক তাজুল ইসলাম। আর বাকি দুই আসামি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত নূর হোসেনের সহকারী সানাউল্লাহ সানা ও ম্যানেজার শাহজাহান।
এছাড়া বিচারিক আদালতের রায়ে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ৯ আসামিও র্যাবের বরখাস্ত কর্মকর্তা ও সদস্য। তাদের মধ্যে কনস্টেবল হাবিবুর রহমানের ১৭ বছর, এএসআই আবুল কালাম আজাদ, এএসআই কামাল হোসেন, কনস্টেবল বাবুল হাসান, করপোরাল মোখলেসুর রহমান, ল্যান্স করপোরাল রুহুল আমিন ও সিপাহি নুরুজ্জামানের ১০ বছর করে এবং এএসআই বজলুর রহমান ও হাবিলদার নাসির উদ্দিনের সাত বছর করে কারাদণ্ডাদেশ উচ্চ আদালতে বহাল রয়েছেন। তাদের মধ্যে মোখলেসুর রহমান ও কামাল হোসেন পলাতক।
তবে নিম্ন আদালত থেকে শুরু করে উচ্চ আদালতের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও রায় কার্যকরের ব্যাপারটি বিলম্ব হওয়ায় সংশয় প্রকাশ করেন মামলার বাদী নিহত সাবেক প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি।
তিনি জানান, নারায়ণগঞ্জের সাত হত্যা মামলা সারাদেশের আলোচিত একটি মামলা। এই ঘটনার নৃশংসতা দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা বারবার সরকারের বিভিন্ন দফতরে ঘুরেছি। আজ ১১ বছর হয়েছে। আজও এই আলোচিত হত্যা মামলার রায় বাস্তবায়নের মুখ দেখছে না।
তিনি আরও বলেন, মামলাটি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ঝুলে আছে। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে সাত পরিবারের স্বজনরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে এই হত্যা মামলার বিচারের রায় কার্যকর করার দাবি জানান তিনি।
নিহত জাহাঙ্গীরের স্ত্রী সামসুন নাহার বলেন, জাহাঙ্গীর নিহতের দুই মাস দশ দিন পর তার মেয়ে রওজা মনির জন্ম হয়। মেয়েটি বাবা বলে ডাকতে পারেনি। পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছে সে।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমরা মা-মেয়ে অধীর আগ্রহে বসে আছি, এই নারকীয় হত্যা মামলায় রায় নিজ চোখে দেখার জন্য।
নিহত তাজুল ইসলামের বাবা আবুল খায়ের বলেন, পরিবারের একমাত্র ব্যক্তি ছিল তাজুল ইসলাম। যার আয়ে আমরা সংসারের সবাই চলতাম। আমার আদরের ধনকে যারা হত্যা করেছে তাদের ফাঁসি দেখতে চাই। বর্তমান সরকারের কাছে দ্রুত এটির নিষ্পত্তি করে রায় কার্যকর করার জোর দাবি জানাই।
মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, বহুল আলোচিত নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার রায়টি চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। গত ১০ বছরে এ মামলার বিচারের দুটি ধাপ শেষ হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের পর তিন বছরের মধ্যে দুটি ধাপে বিচারিক আদালত ও হাইকোর্টে শেষ হয় বিচার। পরে সেই মামলার চূড়ান্ত বিচার গত আট বছর ধরে আপিল বিভাগে ঝুলে আছে। দীর্ঘ সময় ধরে আপিলসহ ডেথ রেফারেন্স (আসামিদের মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়ায় আমি হতাশ। রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি জানাচ্ছি।
নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ কোর্টের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ জাকির জানান, এই মামলা নিয়ে বর্তমান অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে একাধিকবার কথা বলেছি। এই মামলা যেন শিগগিরই নিষ্পত্তি হয় সেজন্য তিনি নিজে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। আইন মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের বারবার আশ্বস্ত করে বলা হয়েছে, এই মামলার আসামিরা কোনোভাবেই কোনো সুবিধা নিতে পারবে না। বরং বাদীপক্ষ নিম্ন আদালতে, সুপ্রিম কোর্টে যেমনিভাবে ন্যায়বিচার পেয়েছে ঠিক তেমনিভাবে লিভ টু আপিল বিভাগে আসামিদের চূড়ান্ত শাস্তি বহাল থাকার বিষয়ে রাষ্ট্র পরিপূর্ণভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ আদালতে মামলায় হাজিরা দিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি পশ্চিমপাড়া এলাকার নিজ বাসভবনে ফেরার পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের খান সাহেব ওসমানী স্টেডিয়ামের সামনে থেকে অপহরণ হন তখনকার সিটি করপোরেশনের তৎকালীন প্যানেল মেয়র ও ২নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার, নজরুলের বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, জাহাঙ্গীর আলম ও চন্দন সরকারের গাড়িচালক মো. ইব্রাহীম। এর ৩ দিন পর ৩০ এপ্রিল ৬ জন এবং ১ মে এক জনের মরদেহ সিদ্ধিরগঞ্জের শীতলক্ষ্যায় ভেসে ওঠে।
এ ঘটনায় নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি ও চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল বাদী হয়ে ফতুল্লা থানায় দুটি মামলা করেন। মামলায় ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি রায় দেন বিচারিক আদালত। রায়ে ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পরে রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন ২৮ আসামি। ২০১৮ সালের ২২ আগস্ট বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া ১১ আসামিকে যাবজ্জীবন এবং বাকি ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন হাইকোর্ট।
তথ্যসুত্রঃ জাগো নিউজ