বিবিসি বাংলা
শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ও আদালতে যেসব হত্যা মামলা হয়েছে তাতে নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতনামা ঢালাওভাবে কয়েকশ জনকে আসামি করার বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের মানবাধিকার কর্মীরা ও সরকারের কর্মকর্তারাও একে ‘ঢালাও মামলা’ বলে বর্ণনা করছেন।
এরকম অনেক মামলায় মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক, পেশাজীবী, রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ নামে-বেনামে অনেককে আসামি করা হয়েছে।
এরকম মামলায় সরকারও বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে বলে তাদের নানা বক্তব্যে বেরিয়ে এসেছে, যদিও এ ধরনের মামলা বন্ধে জোরালো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় বহু নিহতের ঘটনায় করা এসব মামলায় কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা গেছে বাদীরাও জানেন না আসামি হচ্ছে কারা। অনেক ক্ষেত্রে আইনজীবীরা বা পুলিশ মামলা সাজিয়ে দিচ্ছে।
এসব মামলায় এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় দুই ডজনেরও বেশি নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এছাড়াও পুলিশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ অন্তত ২০ জন কর্মকর্তাকে এসব মামলাতেই গ্রেফতার করা হয়েছে। শীর্ষ পর্যায়ের সরকারি সাবেক অন্তত ছয় জন কর্মকর্তাও রয়েছেন এ তালিকায়।
শুধু তাই নয় ৫৩ জন সাবেক সচিবকেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে। এমনকি অনেক পেশাদার সাংবাদিককে হত্যা মামলাতেও আসামি করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়েও বিভিন্ন আন্দোলন চলার সময় অনেক সাধারণ মানুষকে আসামি করার এবং গ্রেফতার করার অভিযোগ ছিল। কিন্তু সরকার বদলের পরে সেই চিত্র পাল্টে নি।
ফলে প্রশ্ন উঠেছে এ ধরনের মামলার বিষয়ে বিব্রত হওয়া ছাড়া সরকারের ভূমিকা কী হতে পারে?
কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে সরকার? আইনিভাবে এ ধরনের মামলার ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নেয়া যায়?
‘হয়রানি বন্ধে ব্যবস্থা কেন নয়?’
মানবাধিকার সংস্থা বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্নার মামলাটির উদাহরণ দিয়ে প্রশ্ন তোলেন হয়রানি বন্ধে অন্যান্য মামলার ক্ষেত্রেও একই ধরনের ব্যবস্থা কেন নেয়া হবে না?
গত ১৭ই অক্টোবর সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এবং বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপার্সন জেড আই খান পান্নার বিরুদ্ধে রাজধানীর খিলগাঁও থানায় এমনই একটি হত্যাচেষ্টা মামলা করা হয়।
বাদী মো. বাকের সে সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলেছেন তিনি মি. পান্নাকে চেনেন না এবং মামলায় কাদের আসামি করা হয়েছে সেটি জানা নেই তার।
ব্যাপক সমালোচনার পরে ওই মামলার বাদী মি. বাকের ‘অজ্ঞতা ও ভুলবশত আসামি করা হয়েছে’ এমন কারণ দেখিয়ে আবেদন করলে এজাহার থেকে মি. পান্নার নাম বাদ দেয়া হয়।
মিজ হোসেন বলেন, “ যদিও জামিন দেয়ার সিদ্ধান্ত বিচারকের কিন্তু সরকার জামিনের বিরোধীতা না করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এটা তারাই চিহ্নিত করেছে মামলাগুলোতে কোন কোন আসামির নামের ক্ষেত্রে স্পষ্টতই অযৌক্তিক এবং মিথ্যা অভিযোগ করা হয়েছে”।
ফলে এসব মামলা কিভাবে এগিয়ে যাচ্ছে এবং এজাহারে আসামি কে হবে কারা তা নির্ধারণ করছে তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন এই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী।
“ কারা ভুক্তভোগী পরিবারগুলির কাছে এফআইআরে আসামির নামের তালিকা দিচ্ছে এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তাগাদা দিচ্ছে? হয়রানি বন্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায় এটা আইনজীবী জেড আই খান পান্নার মামলায় পরিস্কার হয়েছে। তাহলে অন্য মামলার ক্ষেত্রে কেন একই ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে না?” বলেন মিজ হোসেন।
একইসাথে এ বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেয়া যায় সেটা সরকার রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তার কাছেও জানতে চাইতে পারে বলে মন্তব্য করেন মিজ হোসেন।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের মতে, এ ধরনের মামলা গ্রহণের ক্ষেত্রে আদালত এবং থানাকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। কারণ যতগুলো মামলা হয়েছে সবগুলোর এজাহারই প্রায় এক।
ফলে সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষ হিসেবে থানায় পুলিশ এবং আদালতে রাষ্ট্রপক্ষকে উদ্যোগী হতে হবে বলে জানান আইনজীবীরা।
একইসাথে কাউকে হেনস্তা করতে, ষড়যন্ত্রমূলক বা মিথ্যা মামলা করা হলে তার প্রতিকার ফৌজদারী আইনেই রয়েছে বলে জানান জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা।
এদিকে, সরকারই কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারে বলে মনে করেন এ ধরনের মামলার মুখোমুখি হওয়া জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মি. পান্না।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “ এ ধরনের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ অন্তত জামিনের ব্যবস্থাতো করতে পারে। মামলা নেয়ার সময় আদালততো দেখবে এ মামলাটা কী রকমের। আর আমরাতো দেখছি যে সবগুলোতেই স্ক্রিপ্ট এক।”
“আবার কোর্ট যদি প্রাইমা ফেসি মানে প্রাথমিক সত্যতা না পায় তাহলে সে মামলা খারিজও করতে পারে” বলেন মি. পান্না।
আবার সরকারি কর্মকর্তারাও ঢালাও মামলা রোধের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে বলে জানান এই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী। এক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থানাকে নির্দেশনা দিতে পারে বলে মন্তব্য করেন মি. পান্না।
“থানা দেখবে এর কোন ‘প্রাইমা ফেসি’ কেস আছে কি না। থানাতো এমনিতেই রেগুলার রিফিউজ করে। এগুলাতো তারা রিফিউজ করতে পারে” বলেন মি. পান্না।
‘আইনেই রয়েছে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা’
বাংলাদেশের ফৌজদারি আইনেই মিথ্যা মামলা, কাউকে হেনস্তা করা বা ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মামলা করলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার বিধান রয়েছে বলে জানান সুপ্রিম কোর্টের আরেকজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক।
বিবিসি বাংলাকে মি. মালিক বলেন, “ থানায় এজাহার করার সময়ই মামলার বাদীকে যদি প্রশ্ন করা যায় যে ঘটনার সময় তারা ছিল কী না, ৫০ জন জ্ঞাত বা দেড়শ জন অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে মামলা করছে তাদের চেনে কী না যদি পুলিশ প্রশ্ন করে একটারও উত্তর তারা দিতে পারবে না”।
“থানায় যে ইন্সপেক্টর বা সাব ইন্সপেক্টর মামলা নিচ্ছে তাকে কোর্টে গিয়ে সাক্ষী দিতে হয়। কোর্টে গিয়ে তাকে বলতে হয় মামলা আমি লিখেছি, তাকে জিজ্ঞেস করেছি। তারা তো কেউ জিজ্ঞেস করে না। প্রমাণ তো হয়ে যাবে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে কিনা তাতেই”।
এ ধরনের মামলা আওয়ামী লীগের আমলেও হয়েছে মন্তব্য করে মি. মালিক বলেন, “ ওইসব মামলার জন্য কাউকে আইনের মুখোমুখি করা হয় নি বলে তা এখনও চলছে। রেশ রয়ে গেছে”।
কয়েকজন বাদীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এসব মামলা দায়ের করা হ্রাস পাবে বলেও মন্তব্য করেন মি. মালিক।
“ঢালাওভাবে জেনেশুনে এসব মিথ্যা মামলা করার জন্য দুই-চারজনকে আইনের মুখোমুখি করলে তাহলে ধারণা করা যায় যে এ ধরনের মামলা করার প্রবণতা অনেকাংশে হ্রাস পাবে” বলেন তিনি।
এদিকে গত শনিবার পুলিশের নবনিযুক্ত মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম নির্দেশ দিয়েছেন, মামলার নামে নিরীহ মানুষকে যেন হয়রানি করা না হয়। নিরীহ কারো বিরুদ্ধে মামলা হলে যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তা প্রত্যাহার করার জন্য ব্যবস্থা নিতেও তিনি নির্দেশ দিয়েছেন।
অন্যদিকে গত ১৮ই নভেম্বর একটি সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, ”কোনও ভুক্তভোগী যদি মামলা দেয়, তাকে তো আমরা বলতে পারি না, আপনি মামলা দিয়েন না। তবে পুলিশকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে দ্রুত তদন্ত করে মামলার নামে যাদের হয়রানি করা হচ্ছে তাদের বাদ দেওয়ার জন্য। যাদের বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ নেই, তাদের যেন দ্রুত বাদ দেওয়া হয়।”
ঢালাও মামলার প্রসঙ্গ যেভাবে এলো
ঢালাও মামলার বিষয়টি নিয়ে সরকারও যে বিব্রত, তা তাদের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের বক্তব্যে নানা সময়ে বেরিয়ে এসেছে।
১২ই নভেম্বর ঢাকার বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউটে বিচার বিভাগ সংক্রান্ত সংস্কার কমিশনের সদস্যদের সাথে প্রথমবারের মতো বৈঠক করেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ।
এরপর এক ব্রিফিং এ মি. নজরুল সাংবাদিকদের জানান বিগত সরকারের আমলে সরকারের পক্ষ থেকে গায়েবি মামলা করা হতো। এ সরকার (অন্তর্বর্তী সরকার) কারো বিরুদ্ধে কোন মামলা করছে না।
“বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে গায়েবি মামলা হতো। সরকারের পক্ষ থেকে গায়েবি মামলা দিত। আর এখন আমরা সরকারের পক্ষ থেকে কোনো-মামলা টামলা দিচ্ছি না। সাধারণ লোকজন, ভুক্তভোগী লোকজন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তারা অন্যদের ব্যাপারে ঢালাও মামলা দিচ্ছে” বলেছেন মি. নজরুল।
একইসাথে এসব ‘ঢালাও মামলা’ বিব্রতকর উল্লেখ করে তিনি বলেন, “ঢালাও মামলার একটা খুব মারাত্মক প্রকোপ দেশে দেখা দিয়েছে। এটা আমাদেরকে অত্যন্ত বিব্রত করে”।
এ মাসেই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ঢালাও হত্যা মামলায় অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে একটি বিবৃতি দিয়েছে সম্পাদক পরিষদ। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলার তথ্য চেয়েছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। তবে এ নিয়ে আর কে উদ্যোগ দেখা যায়নি।
নভেম্বর মাসের মাঝামাঝিতে স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ”এখন অনেক মামলা হচ্ছে, তাতে অনেক নিরপরাধ লোকদের আসামি করা হচ্ছে। আমরা সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছি, কারও বিরুদ্ধে হয়রানি করতে মামলা দায়ের করলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
যদিও এ ধরনের ঘটনায় কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে এখনো জানা যায়নি।