ষ্টাফ রিপোর্টার:
নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচিত-সমালোচিত ব্যক্তিত্ব বীরমুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব মোহাম্মদ আলী। ফতুল্লা থানা এনায়েতনগর ইউনিয়নের বাসিন্দা হলেও পরিচিতির পরিধি দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপি। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’য়ের সিনিয়র সহ-সভাপতি থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার পর্যন্ত ছিল তার সরব উপস্থিতি। ওয়ান ইলেভেনের পটপরিবর্তনে যার ছিল গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা। শুধু তাই নয় দেশের প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দলের সুধা পান করা মোহাম্মদ আলী ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সহ সংসদ ও স্থানীয় নির্বাচনেও ছিলেন গেম মেকারের ভুমিকায়। বর্তমানে জেলার রাজনৈতিক অঙ্গনের নেতার কাতারে থাকা বেশ কিছু শীর্ষ রয়েছে তার। এম পি হওয়ার প্রত্যাশায় স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের ২৭ জানুয়ারী সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ- ৪ আসনে সতন্ত্র প্রার্থী হয়ে টেবিল ঘড়ি প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিপুল ভরাডুবি হয়েছিলো এই বিতর্কিত এই রাজনৈতিক নেতার। তৎকালীন সময়ে নারায়নগঞ্জের -৪ আসনে বিএনপির সংসদ সদস্য বীরমুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম বিএনপি সরকারের স্বরাষ্ট মন্ত্রী মতিন চৌধুরী ও জেলা বিএনপির সভাপতি রোকন উদ্দীন মোল্লার সাথে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার নিয়ে কোনঠাসা হয়ে শিল্পপতি মোহাম্মদ আলীর স্বরনাপন্ন হন কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম সিরাজ। এমপি হওয়ার বাসনায় সুযোগটা ভাল ভাবে কাজে লাগান মোহাম্মদ আলী।
১৯৯৫ সালে ফতুল্লা ডি আই টি মাঠে বিশাল সমাবেশ আয়োজনের মাধ্যমে বিএনপির চেয়ারপার্সন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে এনে বিএনপিতে যোগদান করেন শিল্পপতি মোহাম্মদ আলী। সে সমাবেশে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন ফতুল্লা ডিআইটি মাঠে কলেজ ও হাসপাতালে প্রতিষ্ঠা করবেন। তার সে ঘোষনা আজও আলোর মুখ দেখেনি ফতুল্লার মানুষ। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী বিএনপির এক তরফা নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে এমপি হন তিনি। যদিও খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহনের ১৭ দিনের মধ্যে সংসদ ভেঙ্গে দেন। ১৭ দিনের জন্য মোহাম্মদ আলী এমপি হলেও তার নামের পাশে খেতাব হয়ে যায় চিরস্থায়ী। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে দলীয় মনোনয় দেয়া হলেও নির্বাচনে অংশ নেন সুচতুুর মোহাম্মদ আলী। ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসে। আওয়ামীলীগ সরকারের ৫ বছর রাজনৈতিক ভাবে কোনঠাসা থাকলেও ২০০১ সালের ১লা অক্টোবর নির্বানে আবারো গর্জে ওঠেন তিনি। সে নির্বাচনে বিএনপির দলীয় মনোনয়ন সিদ্ধিরগঞ্জের ব্যবসায়ী সফর আলী ভুইয়া দেয়া হলেও পরে মো. আলীর কারিশমায় মনোনয়ন ভাগিয়ে আনেন বীরমুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন। আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থী শামীম ওসমানকে পরাজিত এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন। নির্বাচনের পর হালুয়া রুটির ভাগবাটোয়ার নিয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় দুজনের মাঝে। দুই ভাগে বিভক্ত হয় ফতুল্লায় বিএনপির রাজনীতি।
তাদের চলমান বিরোধে উন্নয়ন বঞ্চিত হয় ফতুল্লার মানুষ। ২০০৬ সাল ২২ জানুয়ারী সালের বাতিল হওয়া সংসদ নির্বাচনে বিএনপির দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিল মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন। তখন বিএনপির দলীয় প্রার্থী মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিনকে বিরোধীতা করে স্বতন্ত্র প্রার্থী সফর আলী ভুইয়ার পালকিতে ওঠেছিলেন মোহাম্মদ আলী। সে সময় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই এর সভায় সংগঠনের সভাপতি মীর নাসির উদ্দীন দেশের বাহিরে থাকায় সভাপতিত্ব করেন সিনিয়র সহ-সভাপতি মোহাম্মদ আলী। সে সভায় মোহাম্মদ আলীর বক্তব্যে দেশে জরুরী অবস্থা জারি করেছিলেন তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টা ইয়াজ উদ্দীন আহম্মেদ। পরবর্তীতে কয়েকটি অনুষ্ঠানে কথাটি গর্বের সাথে বলেছিলেন তিনি।
২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপির দলীয় মনোনয়ন মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন পেলেও মামলা সংক্রান্ত জটিলতায় তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে না পারায় নাটকীয় ভাবে মনোনয়ন পেয়েছিলেন রাজনীতিতে নতুন মুখ শিল্পপতি আলহাজ্ব মোঃ শাহ আলম। লোক মুখে শোনা গেছে, এখানেও মোহাম্মদ আলীর কারিশমা ছিল। নির্বাচনের মাঝপথে লেনদেন সংক্রান্ত জটিলতা সৃষ্টি হয় মোহাম্মদ আলী ও মোহাম্মদ শাহ আলমের মাঝে। বিএনপি নেতা এম এ হোসেন সাইদ ওরফে পাঞ্জাবী সাইদের মাধ্যমে জটিলতা নিরসন হলেও মনের মিল ঘটেনি আজও।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী চিত্র নায়িকা সারাহ বেগম কবরী এমপি নির্বাচিত হলে সুচতুর মোহাম্মদ আলী তার সাথে সখ্যতা সৃষ্টি করে ফায়দা হাসেল করেন। ২০১৪ সালের ৭ জানুয়ারীর ভোট বিহীন নির্বচনে গডফাদার শামীম ওসমান পুনরায় এমপি নির্বাচিত হলে মোহাম্মদ আলী আশ্রয় নেন তার বড় ভাই শিল্পপতি সেলিম ওসমানের কাছে। নারায়ণগঞ্জ – ৫ আসনের জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য নাসিম ওসমানের মৃত্যুর পর আসন খালি হলে জাতীয় পার্টির মনোয়ন পান সেলিম ওসমান। তাকে নির্বাচিত করার জন্য জাল ভোটের বাহারি খেলায় গুরুত্ব ভুমিকা পালন করেন মোহাম্মদ আলী। ২০১৮ সালের নির্বাচনে গডফাদার শামীম ওসমানের জন্য ফতুল্লার বিভিন্ন এলাকায় ওঠান বৈঠকে নৌকা প্রতীকে ভোট চেয়েছিলেন তিনি। শামীম ওসমান নির্বাচিত হলে নারায়ণগঞ্জ -৪ আসনে দ্বিতীয় এমপির ভুমিকায় অবতীর্ন হন মোহাম্মদ আলী। দখল বাজি, ভুমি দখল, চোরাই তেল সিন্ডিকেট সহ বিভিন্ন সেক্টর নিয়ন্ত্রন করতেন শক্ত হাতে। নিজেকে নিরপেক্ষ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জাহির করলেও আওয়ামীলীগের দলীয় সহ বিভিন্ন সরকারী অনুষ্ঠান তার মুখ থেকে সরকারের গুনগান সহ জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধুর শ্লোগান, তারই ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে জেলা প্রশাসকের আয়োজিত মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে জয় বাংলার শ্লোগান দিয়ে বিএনপি পন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের রোষানলে পড়েন তিনি। তার বিরুদ্ধে শহরের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল সহ প্রতিবাদ সভা করের বীরমুক্তিযোদ্ধা ও মহানগর বিএনপি ও অংগ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। পরবর্তীতে তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করে সে যাত্রায় রক্ষা পান।
তবে নারায়ণগঞ্জের অধিকাংশ মানুষের দাবী,মোহাম্মদ আলী একজন সুচতুর ও সুবিধাবাদী লোক। নিজের স্বার্থের জন্য তিনি সব মন্দিরে পুজারী হতেও দ্বিধাবোধ করেননি। বীর মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার সুবাদে তিনি অনেকের কাছে মুরুব্বী হিসেবে খ্যাত। যার ফলে তিনি সবস্থানেই নিজের সুবিধাগুলো আদায়ের ক্ষেত্রে তৎপর থাকেন।