যুগান্তর অনলাইনে প্রকাশিত সংবাদটি জাগো নারায়ণগঞ্জ২৪.কমের পাঠকের সুবিধার জন্য হুবুহু প্রকাশ করা হলোঃ
আট মাসেও গ্রেফতার না হওয়ায় ক্ষোভ
আন্দোলনে ছাত্র–জনতাকে লক্ষ্য করে প্রকাশ্যে গুলি ছোড়ে * চাঁদাবাজি, জমি দখল, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা ও খুন ছিল তার নেশা
ছাত্র–জনতার আন্দোলনে প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে গুলি ছোড়া শামীম ওসমানের ক্যাডার শাহ নিজাম ও তার সহযোগীদের আইনের আওতায় আনতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
দীর্ঘ আট মাসেও নারায়ণগঞ্জের গডফাদার শামীম ওসমানের ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’ শাহ নিজাম গ্রেফতার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও ছাত্র–জনতা। শামীম ওসমানের আশ্রয়–প্রশ্রয়ে থেকে চাঁদাবাজি, জমি দখল, টেন্ডারবাজি ও মাদক ব্যবসা করে শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন শাহ নিজাম। তার বিরুদ্ধে ডজনের বেশি হত্যা মামলা রয়েছে। পুলিশ বলছে, শাহ নিজামসহ শামীম ওসমানের ক্যাডারদের গ্রেফতারে চেষ্টা অব্যাহত আছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই (শুক্রবার) দুপুরে শামীম ওসমানের নেতৃত্বে শাহ নিজাম, অয়ন ওসমান, ভিকি, লাভলুসহ শতাধিক ক্যাডার ছাত্র–জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করে। চাষাঢ়া থেকে গুলি করতে করতে গুলশান সিনেমা হল পর্যন্ত যায় ক্যাডাররা।
ওইদিনই নয়ামাটি এলাকায় নিজ বাসার ছাদে বাবার কোলে থাকা শিশু রিয়া গোপ মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে পরে হাসপাতালে মারা যায়। গুলিবর্ষণের সময় অগ্রভাগে ছিলেন শাহ নিজাম। তাকে অস্ত্র হাতে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। এছাড়া নারায়ণগঞ্জে বিগত আওয়ামী লীগ আমলে কোথাও কোনো সহিংসতা হলেই শাহ নিজাম পিস্তল উঁচু করে গুলি ছুড়তেন। শামীম ওসমানের খুবই আস্থাভাজন ছিলেন নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক শাহ নিজাম ওরফে ‘পিস্তল নিজাম’।
তাকে দিয়ে শামীম ওসমান নিয়ন্ত্রণ করতেন তার নির্বাচনি এলাকা ফতুল্লা–সিদ্ধিরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ সদর, বন্দরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলা। বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি, জমি দখল, বিভিন্ন দপ্তরে টেন্ডারবাজি ছিল তার মূল কাজ। তাদের অত্যাচার–নির্যাতনে অতিষ্ঠ ছিল নারায়ণগঞ্জবাসী।
শাহ নিজামের বিশাল ক্যাডার বাহিনীর কাছে জিম্মি ছিলেন নিজ দলের নেতাকর্মীরাও। শামীম ওসমানের সরাসরি আশ্রয়–প্রশ্রয়ে বিগত ১৬ বছরে শতকোটি টাকার মালিক বনে যান নিজাম। চলতেন বিলাসবহুল দামি গাড়িতে। থাকতেন ধানমন্ডি লেকের পাশে বিশাল ফ্ল্যাটে।
পাঁচ আগস্ট পট পরিবর্তনের পর শাহ নিজামের গুরু সাবেক সংসদ–সদস্য, গডফাদার শামীম ওসমান দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এরপর নারায়ণগঞ্জে আর দেখা যায়নি নিজামকে। চলে যান আত্মগোপনে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলি করে হত্যার ঘটনায় ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ সদর ও সোনারগাঁ থানায় তার বিরুদ্ধে ডজনের বেশি মামলা হয়েছে।
অপরাধসাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণে এলাকায়–এলাকায় আলাদা সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী ছিল নিজামের। এছাড়া বিভিন্ন পাড়া–মহল্লায় ছিল কিশোর গ্যাং। এদের নিজ নিজ এলাকা ভাগ করে দিয়ে চালাতেন চাঁদাবাজি, দখলবাজি, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপকর্ম।
ফতুল্লা, পাগলা, নয়ামাটি, দেলপাড়া, তুষার ধারা, গিরিধারা, কোতালের বাগ, রামারবাগ, তক্কার মাঠসহ বিভিন্ন এলাকায় শাহ নিজামের ক্যাডাররা প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসা করত। নিজাম নগরীতে গড়ে তোলেন দুটি টর্চার সেল।
একটি চাষাঢ়ায় সায়াম প্লাজা মাকের্টের তৃতীয় তলায়। ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে বিচারের নামে এই টর্চার সেলে এক ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে আসে ক্যাডাররা। পরে ওই ব্যক্তির স্ত্রী র্যাবের কাছে অভিযোগ দিলে টর্চার সেলে অভিযান চালান র্যাব–১১ কালিরবাজার ক্যাম্পের সদস্যরা।
ঢাকা–নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের পাশে সড়ক ও জনপথের জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয় নাসিম ওসমান মেমোরিয়াল পার্ক। যেটি ছিল শাহ নিজামের দ্বিতীয় আস্তানা (টর্চার সেল)। মাদকের বড় বড় চালানের ডিল হতো পার্কের অফিসে বসেই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শাহ নিজামের এসব অপকর্মের অন্যতম সহযোগী ছিলেন কুতুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনিরুল আলম সেন্টু। ৫ আগস্টের পর পলাতক রয়েছেন তিনিও। তার বিরুদ্ধে দায়ের হয়েছে একাধিক হত্যা মামলা।
ফতুল্লার ভুঁইঘর, দেলপাড়া, গিরিধারা, তুষার ধারা, নয়ামাটি, সাইনবোর্ড, সিদ্ধিরগঞ্জের জালকুড়ি ও সানারপাড় এলাকায় কেউ জমি বেচাকেনা করলে নিজামকে চাঁদা দিতে হতো। কেউ নতুন বাড়ি নির্মাণ করলে তার ক্যাডাররা বাধা ও হুমকি দিত। পরে চাহিদামতো আদায় করা হতো চাঁদা।
ঢাকা–নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের স্টেডিয়ামের পাশে ইতালি প্রবাসী নুরুল হক নামের এক ব্যক্তি ছয় শতাংশ জমি কিনেন বাড়ি করার জন্য। নুরুল হক অভিযোগ করেন, শাহ নিজাম তার ক্যাডারদের দিয়ে জমিতে ওয়ারিশ আছে এমন ভুয়া অভিযোগ তুলে স্থাপনা নির্মাণে বাধা দেন। তারা শাহ নিজামের সঙ্গে দেখা করার জন্য বলেন। পরে তার কাছ থেকে কয়েক দফা টাকা নেয় তারা।
২০২২ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ শহরের ফুটপাতে হকার বসানো ও উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে শামীম ওসমানের ক্যাডারদের সঙ্গে সেলিনা হায়াৎ আইভী সমর্থকদের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে মেয়র আইভীসহ অর্ধশত লোক আহত হন। সংঘর্ষ চলার সময় শাহ নিজাম চাষাঢ়া সোনালী ব্যাংকের সামনে কোমর থেকে পিস্তল বের করে প্রকাশ্যে গুলি করেন। পিস্তল উঁচিয়ে শাহ নিজামের গুলি ছোড়ার ওই ছবি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার হয়। এ ঘটনায় আইভীকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে নিজামসহ বেশ কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করা হয়। মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন তদন্ত করছে।
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত শিক্ষার্থী তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যা মামলায় জড়িত রয়েছেন শাহ নিজাম। নিহত ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি জানান, ২০১৩ সালের ৬ মার্চ বিকালে বই পড়ার জন্য ত্বকী কালিরবাজারের বাসা থেকে বের হয়ে চাষাঢ়া সুধীজন পাঠাগারে আসার সময় অয়ন ওসমানের ক্যাডাররা ত্বকীকে অপহরণ করে প্রথমে শাহ নিজামের সায়াম প্লাজার অফিসে নিয়ে যায়। প্রথম দফায় ত্বকীকে নিজামের অফিস (যা টর্চার সেল হিসাবে পরিচিত) নির্যাতন করা হয়।
সেখান থেকে নেওয়া হয় চাষাঢ়া শ্রমকল্যাণ কেন্দ্রের ভেতরে। সেখান থেকে নেওয়া হয় কলেজ রোডে অবস্থিত আজমেরী ওসমানের টার্চার সেলে। সেখানেই ত্বকীকে নির্মমভাবে নির্যাতনে হত্যা করা হয়। পরে লাশ গাড়িতে তুলে শীতলক্ষ্যা নদীর শাখা খালে ফেলা হয়। ত্বকী হত্যা মামলায় গ্রেফতার ১১ আসামির মধ্যে দুই থেকে তিনজন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে শাহ নিজামের নাম এসেছে। রফিউর রাব্বি শাহ নিজামসহ ত্বকী হত্যায় জড়িত সব আসামিকে দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানান।
নারায়ণগঞ্জ জেলা গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক তরিকুল সুজন বলেন, শামীম ওসমানের অন্যতম ক্যাডার ছিল শাহ নিজাম। সে নিজে ছাত্র–জনতার আন্দোলনের সময় কয়েক দফা ছাত্রদের ওপর গুলি করেছে। কিন্তু প্রশাসন তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি। শুধু শাহ নিজাম নয়, শামীম ওসমানের কোনো ক্যাডারই গ্রেফতার হয়নি।
বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। তিনি বলেন, শামীম ওসমান ও তার ক্যাডার বাহিনীর সদস্যরা নারায়ণগঞ্জকে জিম্মি করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত এদের আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো। যাতে এ ধরনের পেশিশক্তি নারায়ণগঞ্জে আর মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়াতে না পারে।