Views: 7
ষ্টাফ রির্পোটার
আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রভাবশালী এমপি এ কে এম শামীম ওসমান নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে টানা তিন মেয়াদে সংসদ সদস্য থাকার সময় দেশে-বিদেশে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। ৫ আগস্টের পর তিনি দেশ ছেড়ে পালালেও এসব সম্পদের খবর আগেই জানিয়েছিলেন সদ্য বিলুপ্ত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াত আইভী। বিদেশ ছাড়াও নারায়ণগঞ্জে সওজের জমি দখল করে প্রয়াত বড় ভাইয়ের নামে পার্ক তৈরি, অনুসারীদের দিয়ে দখলের অভিযোগও আছে শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন টেন্ডার থেকে কমিশন, ব্যাবসায়িক জোন থেকে টাকার ভাগ নেওয়ার বিষয়টি ছিল ওপেন সিক্রেট।
বিদেশে সম্পদ
ঘনিষ্ঠজনরা জানান, শামীম ওসমানের অনেক আগে থেকেই সংযুক্ত আরব আমিরাতে ব্যবসা ছিল। সেখানে আজমান প্রদেশে বাংলাদেশিদের একটি বড় স্টক লটের ব্যবসা ছিল শামীম ওসমান, তাঁর ছেলে অয়ন ওসমান ও শ্যালক তানভীর আহমেদ টিটুর। আজমানে টিটুর ডুপ্লেক্স বাড়ির বিষয়টি আগেই প্রকাশ পেয়েছিল। আজমান ছাড়াও শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মজনু আহমেদের ছিল দ্বৈত নাগরিকত্ব।
তিনি ইংল্যান্ডেও বিপুল টাকা বিনিয়োগ করেছেন। সেখানেও শামীম ওসমানের অংশীদারের বিষয়টি সবাই জানে। শামীম ওসমানের স্ত্রী লিপি ওসমানের ভাই শামীম হোসেন থাকেন আমেরিকার নিউ ইউর্কে। সেখানেও তাঁদের টাকায় বাড়ি কেনার খবর রয়েছে।
সেলিনা হায়াত আইভীর মন্তব্য
২০২২ সালের ৭ মার্চ শহরের শেখ রাসেল পার্কে অনুষ্ঠিত ওই সমাবেশে শামীম ওসমানকে উদ্দেশ করে আইভী বলেছিলেন, যিনি নিজের মুখেই বলেছেন তোলারাম কলেজে টাকার জন্য ফরম পূরণ করতে পারেননি, আজ উনি কোটি কোটি টাকার মালিক। আবার অন্যের দিকে চোখ তোলেন। শামীম ওসমানের ১৬-১৭টি কার্গো জাহাজ আছে জানিয়ে মেয়র আইভী প্রশ্ন তোলেন, ‘উনি কিভাবে রাতারাতি ওই শিপের মালিক হলেন, কিভাবে উনি কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছেন?’ শামীম ওসমানকে ইঙ্গিত করে আরো বলেছিলেন, তিনি (শামীম) যখন-তখন দেশ ছেড়ে চলে যান। শত শত কোটি টাকা পাচার করেছেন দুবাই ও মালয়েশিয়াতে। বাড়িঘর সব জায়গায় করেছেন আবার চলে যাবেন।
দেশে সম্পদ
২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হলফনামা অনুযায়ী, দেশে তাঁর বর্তমানে মোট পাঁচটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলো হলো—মেসার্স জেডএন করপোরেশন, জেডএন শিপিং লাইনস লিমিটেড, মাইশা এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড, খান ব্রাদার্স ইনফোটেক ও উইসজম নিটিং মিলস। এসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ নিজের দোকান ও অন্যান্য খাত থেকে শামীম ওসমান ও তাঁর পরিবারের বার্ষিক আয় ছিল প্রায় ৯০ লাখ টাকা। তবে ১০ বছর আগে তাঁর কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান না থাকলেও বিভিন্ন খাত থেকে তাঁর পরিবারের বার্ষিক আয় দেখানো হয়েছিল প্রায় ৫৫ লাখ টাকা।
এ ছাড়া ২০২৪ সালে শেয়ারের সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক থেকে জামানত সুদ থেকে তাঁর পরিবারের বার্ষিক আয় ছিল প্রায় ৪৮ লাখ টাকা। কিন্তু ২০১৪ সালে শেয়ারের সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক থেকে জামানত হিসেবে শামীম ওসমানের কোনো আয় ছিল না। অন্যদিকে স্ত্রীর আয় ছিল মাত্র ৯২ হাজার ১৫০ টাকা।
২০২৪ সালে বিভিন্ন ব্যাংকে তিনিসহ তাঁর পরিবারের নামে জমা ছিল দুই কোটি ৫০ লাখ টাকা। পাশাপাশি শামীম ওসমানসহ তাঁর পরিবারের নামে প্রায় সাড়ে সাত কোটি টাকা এফডিআর ছিল। কিন্তু ১০ বছর আগে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তাঁদের জমা করা অর্থের পরিমাণ ছিল মাত্র দুই লাখ ৪৬ হাজার টাকা।
২০২৪ সালের হলফনামায় শামীম ওসমানের সোনারগাঁয়ের বারদীতে তিন লাখ ৭৫ হাজার টাকা মূল্যের ১২৩ শতাংশ কৃষিজমি, ৩৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা মূল্যের পূর্বাচলে রাজউকের ১০ কাঠার প্লট এবং ১৬ শতাংশ জমির ওপর ৭৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা মূল্যের দোতলা আবাসিক বাড়ি দেখান। আর ১০ বছর আগে শামীম ওসমান নিজের নামে শুধু ১০ শতাংশ এবং ১৬ শতাংশ জমির ওপর নিজ নামে একটি দোতলা বাড়ি ছিল।
এলজিইডি, গণপূর্ত, শিক্ষা প্রকৌশল
বিভিন্ন উন্নয়নকাজের টেন্ডারগুলো শামীম ওসমান এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাঁর ভয়ে কেউ টেন্ডার ড্রপ করতে পারত না। কে কোন কাজ করবে তা তিনি রাইফেল ক্লাবে বসে নির্ধারণ করে দিতেন। তিনি সব কাজে ৫ থেকে ৭ শতাংশ কমিশন আগে থেকেই নিয়ে নিতেন। নিজের নির্বাচনী এলাকার কোনো কাজ শামীম ওসমানের পছন্দের বাইরের কেউ পায়নি।
সরকারি জমি দখলের অভিযোগ
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ফতুল্লা স্টেডিয়ামের বিপরীত পাশে কুতুবপুর এলাকায় অবস্থিত নারায়ণগঞ্জ সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) মালিকানাধীন ১.৪৪ একর জমি দখলে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন নাসিম ওসমান মেমোরিয়াল পার্ক (নম পার্ক)। এই পার্কটি মূলত তাঁর সেকেন্ড ইন কমান্ড মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহ নিজামের আস্তানা হিসেবে পরিচিত ছিল।
বিভিন্ন শিল্পাঞ্চল ও প্রতিষ্ঠান থেকে মোটা অঙ্কের আয়
তাঁর নির্বাচনী অঞ্চল সিদ্ধিরগঞ্জ ও ফতুল্লা এলাকার বিভিন্ন শিল্প-কারখানা থেকে শামীম ওসমানের মোটা অঙ্কের টাকা আয় হতো। সিদ্ধিরগঞ্জে অবস্থিত আদমজী ইপিজেডের অর্ধশতাধিক পোশাক কারখানার ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করত শামীম ওসমানের অনুসারীরা। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি অংশই পরিচালনা করতেন সিদ্ধিরগঞ্জে শামীম ওসমানের সেকেন্ড ইন কমান্ড যুবলীগের আহ্বায়ক ও নাসিকের সাবেক ৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মতিউর রহমান মতি। যিনি দুদকের করা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত ও মানি লন্ডারিং মামলায় কারাবরণ করেন। এ ছাড়া শামীম ওসমানের ছত্রচ্ছায়ায় সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজি ইয়াসিন মিয়া, যুবলীগের লিটন ওরফে গুজা লিটন, সাবেক কাউন্সিলর সিরাজুল ইসলাম মণ্ডল, বঙ্গবন্ধু শিশু-কিশোর পরিষদ নেতা আক্তার হোসেন ওরফে পানি আক্তার আদমজী ইপিজেড নিয়ন্ত্রণ করতেন। এই ইপিজেডে মালপত্র সাপ্লাই, ঝুট নামানো, ওয়েস্টেজ মালপত্র নামানোর ক্ষেত্রে মাসে অন্তত ১০ কোটি টাকা আয়ের একটি অংশ নিতেন শামীম ওসমান। সেখান থেকে ছেলে অয়ন ওসমান ও স্থানীয় নেতাকর্মীদের দেওয়া হতো বাকি টাকা।
ইপিজেড বাদেও সিদ্ধিরগঞ্জে অবস্থিত পদ্মা ও মেঘনা ডিপো নিয়ন্ত্রণ করতেন শামীম ওসমানের আরেক আস্থাভাজন আশরাফ হোসেন। পাশাপাশি বিভিন্ন পোশাক কারখানায় শামীম ওসমানের অনুসারীদের একক আধিপত্য ছিল। এ ছাড়া সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিভিন্ন ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণ করতেন শামীম ওসমানের শ্যালক জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এহসানুল হক নিপু।
ফতুল্লা বিসিক এলাকায় পোশাক কারখানাগুলো নিয়ন্ত্রণ করতেন ছাত্রলীগ নেতা কাউসার আহমেদ, লালপুর এলাকার জুয়েল, ছাত্রলীগ নেতা ইমরান হোসেন শুভ, কুতুবপুর এলাকার ইমরান হোসেন লিমনসহ ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী, যাঁরা প্রত্যেকেই শামীম ওসমানপুত্র অয়ন ওসমানের অনুসারী। শুধু বিসিক থেকেই শামীম ওসমানের স্ত্রী লিপি ওসমান এবং অয়ন ওসমানের নামে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা আসত।
নারায়ণগঞ্জ শহর ও শহরতলির ইন্টারনেট ব্যবসা ছিল অয়ন ওসমানের মালিকানাধীন জেডএন ইন্টারন্যাশনালের। এর বাইরে কেউ স্থানীয়ভাবে নেট চালাতে পারত না। কেউ চালাতে গেলে তাদের মোটা অঙ্কের চাঁদা দিতে হতো।
অন্য আসনেও প্রভাব খাটাতেন
নিজের নির্বাচনী আসনের বাইরেও প্রভাব খাটাতেন শামীম ওসমান। ২০০৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ-৩ (সোনারগাঁ) আসনের এমপি ছিলেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য লিয়াকত হোসেন খোকা। তিনি শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু খোকা এমপি থাকলেও সোনারগাঁয়ের বালু ব্যবসা, উন্নয়নকাজের টেন্ডার ছিল শামীম ওসমানের দখলে। অয়ন ওসমানের বন্ধু সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সোহাগ রনি এক দশকে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। তিনিও নিয়মিত ওসমানদের কমিশন দিতেন।
সোনারগাঁয়ের বালু ব্যবসা ছিল পিরোজপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মাসুদুর রহমান মাসুমের নিয়ন্ত্রণে। এ ছাড়া সেখানকার ইউনিয়ন পরিষদের কাজেও শামীম ওসমান ও তাঁর স্ত্রী লিপি ওসমান নানাভাবে হস্তক্ষেপ করতেন।
সুত্রঃ কালের কন্ঠ