Views: 4
কোথাও পণ্যের কমতি নেই, তবু দামের চোটে ক্রেতার নিঃশব্দ হাহাকার। কোনো টোটকাতেই বাগে আসছে না নিত্যপণ্যের বল্গাহীন বাজার। সদাই করতে গিয়ে রীতিমতো নাকানি-চুবানি খাচ্ছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। আর পারছেন না তারা। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও বাজার ছিল নিয়ন্ত্রণহীন। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষের আশা ছিল– সিন্ডিকেট বন্ধ হবে, দামের তেজ কমবে। তবে সেই আশাতেও যেন গুড়ে বালি!
গেল এক মাসে, বিশেষ করে সবজির দামে ক্রেতার চোখ কপালে ঠেকেছে! পাশাপাশি ডিম-মুরগিসহ সবকিছুর দামই লাফিয়ে বাড়ছে। ফলে নির্দিষ্ট আয়ের সাধারণ মানুষ জীবন চালাতে খেই হারাচ্ছেন। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর দফায় দফায় বৈঠক করছে। জেলায় জেলায় হয়েছে বিশেষ টাস্কফোর্স; নিয়মিত তদারকিও হচ্ছে। সিন্ডিকেট ধরতে চলছে অভিযান-জরিমানা। দেশের বাইরে থেকে আসছে পণ্য। স্বয়ং বাণিজ্য উপদেষ্টা নিজেই বাজার তদারকিতে মাঠে নেমেছেন। সরকারের এতসব পদক্ষেপের যোগফল ‘শূন্য’।
এ পটভূমিতে ক্রেতাকে খানিকটা স্বস্তি দিতে নতুন সরকার নিয়েছে নতুন উদ্যোগ। আজ মঙ্গলবার থেকে রাজধানীতে ওপেন মার্কেট সেলের (ওএমএস) আওতায় আলু, ডিম, পেঁয়াজের পাশাপাশি বিভিন্ন সবজি বিক্রি শুরু হতে যাচ্ছে। সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে কিনে রাজধানীর নির্দিষ্ট ২০ স্থানে সুলভ মূল্যে সবজি বিক্রি করবে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্ষা মৌসুমে শাকসবজির দাম সব সময় বাড়তি থাকে। এবার এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বন্যা। এ ছাড়া ডলারের উচ্চমূল্য তো আছেই। এর ওপর আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের পর কয়েক দিন চাঁদাবাজি বন্ধ থাকলেও আবার তা শুরু হয়েছে। চতুর্মুখী সংকটে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনতে হিমশিম খাচ্ছে এই সরকার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজারে পণ্য সরবরাহ ঠিক রাখা ও দাম যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার কার্যকর কৌশল না থাকার সুযোগ নিয়ে দাম বাড়াচ্ছে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। এসব উদ্যোগে এ সমস্যার স্থায়ী বা দীর্ঘমেয়াদি সমাধান সম্ভব নয় বলে মনে করেন না তারা। বিশ্লেষকদের পরামর্শ, দ্রব্যমূল্য সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে প্রাইস কমিশন গঠন করতে হবে।
বাজার পরিস্থিতি
গতকাল সোমবারের বাজারে এক কেজি টমেটোর দাম ছিল ২৪০ টাকা, যা এক কেজি ব্রয়লার মুরগির চেয়ে ৪০ টাকা বেশি। আবার ১০০ টাকার ওপরে বিক্রি হচ্ছে অন্তত ছয় থেকে সাত ধরনের সবজি। বাকি সবজির দামও ৮০ টাকার কম নয়।
রাজধানীর কারওয়ান বাজার ও হাতিরপুল কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেছে, ১০০ টাকার নিচে মিলছে শুধু ঢ্যাঁড়শ, পেঁপে আর মুলা। এর মধ্যে প্রতি কেজি ঢ্যাঁড়শ ৮০ থেকে ৯০, পেঁপে ৫০ থেকে ৬০ ও মুলা ৭০ থেকে ৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া পটোলের কেজি ১০০ থেকে ১১০, বরবটি ১২০ থেকে ১৪০ টাকা, গোল বেগুন ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা ও লম্বা বেগুন ১০০ থেকে ১২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া ঝিঙে, ধুন্দল, কাঁকরোল ও উচ্ছের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১১০ টাকা দরে। অস্থিরতা রয়ে গেছে কাঁচামরিচের বাজারে। গতকাল প্রতিকেজি বিক্রি হয়েছে ৪৪০ থেকে ৫০০ টাকা দরে। প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়।
সবজির দর বাড়ার পেছনে নানা কারণের কথা বলছেন আড়তদার, খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা। তারা জানিয়েছেন, অসময়ে লাগাতার বৃষ্টিতে সবজির চারা ও ফুল নষ্ট হয়ে গেছে। তাতে উৎপাদন তলানিতে নেমেছে। যার প্রভাব পড়েছে বাজারে।
বাংলাদেশ পাইকারি কাঁচামাল আড়ত মালিক সমিতির সভাপতি ইমরান মাস্টার বলেন, প্রতি বছর এই সময় বাজারে শীতের কিছু সবজি আগাম আসে। এসব সবজি বেশির ভাগ হয় উত্তরবঙ্গ, কুমিল্লা, নোয়াখালী, কুষ্টিয়া, যশোর ও খুলনা অঞ্চলে। তবে সেই এলাকাগুলোতে পানির কারণে এখন বীজ লাগানো যাচ্ছে না। এসব কারণে সবজির সরবরাহ বাজারে কমছে। তাছাড়া এ সময় শ্রমিক মজুরিও বেশি দিতে হয়। সে জন্য কৃষকরাও এখন তুলনামূলক দাম বেশি নিচ্ছেন।
ওএমএসের আওতায় সবজি
রাজধানীর ২০ স্থানে আজ মঙ্গলবার থেকেই ওএমএসের আওতায় বিভিন্ন সবজি বিক্রি শুরু হচ্ছে। সবজির পাশাপাশি আলু, ডিম, পেঁয়াজও কিনতে পারবেন ক্রেতারা। এ ব্যাপারে কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, নির্দিষ্ট আয়ের মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দিতে আমরা প্রথমবারের মতো সবজি নগরের বিভিন্ন স্পটে বিক্রি করতে যাচ্ছি। ভর্তুকি দরে এসব পণ্য বিক্রি করা হবে। আজ বেলা ১১টায় খাদ্য অধিদপ্তরে বিক্রি কার্যক্রমের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ উপস্থিত থাকবেন।
সচিব জানান, ১৩০ টাকায় এক ডজন ডিম, প্রতি কেজি আলু ৩০ টাকা, পেঁয়াজ ৬০ টাকা ও পটোল ৩০ টাকায় বিক্রি করা হবে। অন্য শাকসবজি বাজারদরের চেয়ে ২০-৩০ শতাংশ কমে বিক্রি হবে। জনপ্রতি সর্বোচ্চ ৫ কেজি আলু, এক ডজন ডিম, ১ কেজি পেঁয়াজ, ১ কেজি কাঁচা পেঁপের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের ৫ কেজি সবজির প্যাকেজ কেনা যাবে। আলু সংগ্রহ করা হবে বগুড়া থেকে। আর সবজি আনা হবে নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন মোকাম থেকে। কর্মসূচিটি চলবে আগামী ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত। যদি এই কর্মসূচি সফল হয়, তবে বিক্রয় পয়েন্ট এবং সময় বাড়ানো হবে। এগ্রিকালচারাল মার্কেটিং বিভাগ, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) এ কাজে সহায়তা দেবে।
কৃষি মন্ত্রণালয় সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে এসব পণ্য সংগ্রহ করবে। গত রোববার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বাসভবনের অফিস কক্ষে এ বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সবজি মিলবে রাজধানীর খাদ্য ভবন, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, মিরপুর-১০, বাসাবো, বছিলা, রায়েরবাজার, রাজারবাগ, মুগদা-উত্তর, মুগদা-দক্ষিণ, পলাশী মোড়, হাজারীবাগ, মোহাম্মদপুর, গাবতলী, মহাখালী বাসস্ট্যান্ড, বেগুনবাড়ি, উত্তরখান, দক্ষিণখান, কামরাঙ্গীরচর, রামপুরা ও জিগাতলা।
সুফল মিলবে কবে
সরকার দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখতে নানা কৌশল হাতে নিলেও এর প্রভাব নেই বাজারে। পণ্যের দাম বাড়ার জন্য বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা দায়ী করেছেন সিন্ডিকেটকে। সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, এসব সিন্ডিকেট ভাঙতে সরকারের বাধা কোথায়। আবার অনেকে দাম বাড়ার পেছনে বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারের নিয়ন্ত্রণের অভাব এবং বাজারে চাহিদা ও জোগান সম্পর্কিত তথ্যে স্বচ্ছতার অভাবকে দুষছেন।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া বলেন, বর্ষা-বন্যার কারণে দাম হয়তো কিছুটা বাড়ত। তবে যেভাবে বাড়ানো হয়েছে, সেটা কারসাজি। আমরা যখন বাজারে যাই, তখন এক রকম আর বাজার থেকে চলে এলে আরেক রকম। চাঁদাবাজি কমেছে; কিন্তু বন্ধ হয়নি। আশা করছি, টাস্কফোর্সের তদারকি ও কম দামে সবজি বিক্রি শুরু হলে এর সুফল মিলবে।
তবে দ্রব্যমূল্য নিয়ে এ সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে প্রাইস কমিশন গঠনের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এ কমিশনের কাছেই তথ্য থাকবে, যে কার কাছে কোন পণ্য কতটা মজুত আছে। এমনকি কে কোন পণ্য আমদানি করল, কতটা বিক্রি করল– এসব তথ্যও তাদের কাছে থাকবে। ফলে কেউ যেমন কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে পারবে না, আবার বাজার সম্পর্কেও একটি পূর্ণ তথ্য-সংবলিত ধারণা সরকারের হাতে থাকবে।
তবে অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাজারের সংকট অনেক গভীর এবং ছোটখাটো যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাতে আপাতত কিছুটা লাভ হলেও দীর্ঘ মেয়াদে ফায়দা হবে না। টাস্কফোর্স জেলা পর্যায়ে কার কাছে কোন পণ্য কতটা মজুত আছে, সেই তথ্য নিতে পারলে মুনাফার চেষ্টা কিছুটা কমতে পারে।
বাজার পরিদর্শনে বাণিজ্য উপদেষ্টা
গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর কারওয়ান বাজার পরিদশর্ন করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। এ সময় তিনি বলেন, অনেকে বলেন সরকার দাম কমানোর ব্যাপারে চেষ্টা করছে না। এ জন্য জিনিসপত্রের দাম বেশি। আমরা তো চেষ্টা করছি। বন্যার কারণে চাহিদার তুলনায় বেশ কিছু পণ্য সরবরাহে ঘাটতির কারণে বাজার পরিস্থিতি কিছুটা খারাপ অবস্থায় আছে। চাহিদা ও সরবরাহের পার্থক্য কমানোর চেষ্টা করছে সরকার। টাস্কফোর্স বা বাজার তদারকির কারণ হলো উৎপাদন খরচ আর ভোক্তার কাছ থেকে নেওয়া দামের পার্থক্য যেন কম থাকে। সিন্ডিকেটের বিষয়ে তিনি বলেন, যারা বাজারে সিন্ডিকেট করছে, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আগামীতে তা আরও জোরদার করা হবে।
সংগৃহিত