সময়সীমা নির্ধারণ হওয়ায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতিতে গতি বাড়াচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এরই অংশ হিসেবে ঈদের ছুটি শেষে প্রথম কর্মদিবসে গতকাল রোববার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন। তিনি আগামী বৃহস্পতিবার কমিশন সভা আহ্বান করতে পারেন বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য দিনক্ষণ নির্ধারণ নিয়ে রাজনৈতিক উত্তেজনা কমলেও কমিশনের প্রস্তুতিতে অনেক ঘাটতি রয়েছে। নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, সংসদের সীমানা নির্ধারণ, ভোটার তালিকা, নির্বাচনী আচরণবিধিমালা সংশোধন ও নির্বাচনী সরঞ্জাম সংগ্রহের কাজ আটকে রয়েছে পরিকল্পনাতে। এ-সংক্রান্ত আইন সংশোধনের কাজও ফাইল চালাচালিতে সীমাবদ্ধ বলে জানিয়েছেন ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তারা। তবে বৃহস্পতিবার সভা হলে সেখানে এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন তারা।
গতকাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনের নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে সিইসি জানিয়েছেন, সংসদ নির্বাচন কবে হবে তা নিয়ে সরকারের সঙ্গে কমিশনের আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়নি। আলোচনা হলে ইসি সরকারের ‘ভাব’ বুঝতে পারবে। তখন নির্বাচনের তারিখ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। নির্বাচন ফেব্রুয়ারি কিংবা এপ্রিল– যখনই হোক, নির্বাচন কমিশনকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
সংসদ নির্বাচন কখন হবে– এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনার মধ্যে গত শুক্রবার লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে বৈঠক হয়। পরে যৌথ বিবৃতিতে সংস্কার ও বিচার বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি শেষ হলে আগামী বছর রোজা শুরুর আগের সপ্তাহ বা ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন আয়োজনের কথা জানানো হয়।
ইসির সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক
ইসির নির্বাচন পরিচালনা শাখার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এতদিন প্রস্তুতির কাজ ঢিমেতালে চললেও এখন কাজে গতি পাবে বলে তারা আশা করছেন। কারণ রোববার প্রথম কর্মদিবসেই কমর্কর্তাদের সঙ্গে নির্বাচনী প্রস্তুতি নিয়ে মতবিনিময় সভা করেন সিইসি। সভায় কর্মকর্তাদের সার্বিক প্রস্তুতির নির্দেশনা দেন তিনি।
পরে দুপুরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে সিইসি বলেন, ‘কর্মকর্তাদের ওয়ার ফুটিংয়ে (যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত) নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। এখন ধ্যান-ধারণা ও শয়নে-স্বপনে প্রস্তুতি নিয়ে আছে ইসি।’
সংস্কার ও জুলাই সনদের অপেক্ষা
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন বিষয়ের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে উদ্যোগ নিয়েছে। এ বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ চূড়ান্ত করার আগে রাজনৈতিক মতৈক্যেরও প্রয়োজন রয়েছে। ঐকমত্যের ভিত্তিতে ‘জুলাই সনদ’ প্রণয়নের উদ্যোগ চলমান রয়েছে।
ইসির সূত্র জানায়, নির্বাচনী প্রস্তুতিতে সংস্কার ও ঘোষণার অপেক্ষায় থাকা জুলাই সনদে কী কী প্রস্তাব আসছে, সেগুলোকে প্রাধান্য দিতে চাইছে ইসি। এ কারণে প্রস্তুতির যেসব কাজের সঙ্গে সংস্কার ও রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নেই– সেগুলোই এগিয়ে রাখা হচ্ছে। তবে যেসব বিষয়ে এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না, সেগুলোর প্রাথমিক কাজও এগিয়ে রাখছে। তৈরি করা হচ্ছে নির্বাচনী আইন ও বিধিমালাগুলোর সংশোধনীর খসড়া। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এলে তা অনুমোদনের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
ভোটার তালিকা হালনাগাদ
ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ শেষ পর্যায়ে। এ ক্ষেত্রে তপশিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত যাদের বয়স ১৮ বছর হয়ে যাবে, তাদের সবাই ভোট দিতে পারবে– এমন উদ্যোগ নিচ্ছে ইসি। ২০২৬ সালের ২ জানুয়ারি যাদের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হবে, তাদেরও ভোটে অন্তর্ভুক্ত করতে চাইছে তারা। এ কারণে ভোটার তালিকা আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিষয়ে আবেদনের শেষ সময় আগামী ২২ জুন। জুলাই মাসের মধ্যে এ কাজ শেষ করতে চায় ইসি। অন্যান্য নির্বাচনী প্রস্তুতির অংশ হিসেবে স্বচ্ছ ব্যালট বক্স, অফিসিয়াল সিল, মার্কিং সিল, গানি ব্যাগ, লাল গালাসহ ভোট গ্রহণের সরঞ্জাম সংগ্রহের কাজ চলমান রয়েছে। ভোটের এসব সরঞ্জাম সরবরাহের বিষয়ে ইউএনডিপির পক্ষ থেকে ইসিকে সহায়তার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। যদিও ইউএনডিপির সঙ্গে ইসির এ-সংক্রান্ত একটি চুক্তির খসড়া প্রস্তাব চূড়ান্ত হওয়ার পরও ঝুলে রয়েছে। শিগগির এ চুক্তি হবে বলে ইসি কর্মকর্তারা আশা করছেন। পাশাপাশি নির্বাচনী বিভিন্ন ফরম ও প্যাকেট ছাপার প্রস্তুতি নিতে বিজি প্রেসকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
আসনের সীমানা নির্ধারণ
গত ৬ মে সংসদের নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫-এর খসড়ায় নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় উপদেষ্টা পরিষদ। এর পর ১২ মে এ-সংক্রান্ত গেজেট পেয়েছে ইসি। তবে ইসির চাহিদা অনুযায়ী আইন সংশোধন না হওয়ায় অধ্যাদেশটি পুনরায় সরকারের কাছে পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া কীভাবে কাজ শুরু করবে, তা নিয়ে চলছে আলোচনা ও চিঠি চালাচালি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ফলে ঝুলে আছে ৩৬৫টি আবেদন।
রাজনৈতিক বিতর্ক এড়াতে নির্বাচন পরিচালনা-সংক্রান্ত বিভিন্ন ম্যানুয়েল-নির্দেশিকা সংশোধন, সীমানা নির্ধারণসহ ইসির প্রাথমিক কর্মপরিকল্পনায় থাকা অনেক কাজ শুরুই হয়নি। এগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ঐকমত্য কমিশনের চূড়ান্ত সুপারিশের অপেক্ষায় আছেন ইসি কর্মকর্তারা। এ ক্ষেত্রে চূড়ান্ত হওয়ার অপেক্ষায় থাকা জুলাই সনদের সঙ্গে ইসির কোনো বিধিমালা সাংঘর্ষিক হয় কিনা, সেটি দেখার পরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিক-সংক্রান্ত তিনটি নীতিমালার সংশোধনী পাস করার তিন মাস পার হলেও তা কার্যকর করেনি ইসি। দেশীয় পর্যবেক্ষকদের জন্য সংশোধিত ‘নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নীতিমালা, ২০২৫’ গত ১৯ মার্চ নথিতে অনুমোদন করে নির্বাচন কমিশন। এ ছাড়া নির্বাচন এবং ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করা হয়নি। এ-সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেনি ইসি। সারাদেশে স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসায় নির্বাচনের ভোটকেন্দ্র চেয়ে সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে ইসি। তবে এখন পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জবাব পায়নি।
প্রস্তুতির বাইরে কিছু চিন্তা করছি না: সিইসি
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে সিইসি বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন, এটি এখনও কমিশনের কাছে পরিষ্কার নয়। কারও হুকুম বা কারও পরিচালনা কিংবা নির্দেশনায় কাজ করবে না ইসি। কোনো দলের পক্ষ হয়েও কাজ করা হবে না। ভোটকেন্দ্র দখল করে ব্যালট বাক্স লুট করে কেউ নিয়ে যাবে– এমন স্বপ্ন এবার দিবা স্বপ্ন হবে।
নির্বাচনের তারিখ ও তপশিল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখন বিশেষ ধরনের সরকার ও বিশেষ ধরনের পরিস্থিতি চলছে। সংস্কার ও বিচারের বিষয় রয়েছে। এসব নিয়ে সরকার আলোচনা করছে। আমাদের ধারণা ছিল, সরকারের পক্ষ থেকেই একটি তারিখ ঘোষণা হবে। কিন্তু লন্ডন সফরের পরে দায়দায়িত্ব কিছুটা আমাদের ওপর আসছে। সরকারের সঙ্গে কথাবার্তার পর তারা কী চিন্তাভাবনা করছে, একটি ধারণা পাব। তখনই সিদ্ধান্তে আসা যাবে।
লন্ডন বৈঠককে ‘নতুন ডাইমেনশন’ উল্লেখ করে নাসির উদ্দিন বলেন, লন্ডনে যে ঘোষণা এসেছে, অন্যদের মতো মিডিয়া থেকে জেনেছি। নিশ্চয় ভেতরে অনেক আলাপ হয়েছে। সেগুলোও জানতে হবে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য।
এর আগে ইসি কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়ে তিনি বলেন, নির্বাচন-সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ এগিয়ে এসেছে। যতটুকু বাকি রয়েছে, সেগুলো সবাইকে নিয়ে শেষ করতে হবে। আইন অনুযায়ী বিবেক রেখে কাজ করব। যারা খেলে তারা খেলুক। আমরা শুধু রেফারি হয়ে কাজ করব।
সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেওয়া ইসির লক্ষ্য জানিয়ে সিইসি আরও বলেন, আজকের দিনে ইসির শপথ হবে একটা সুষ্ঠু, সুন্দর ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন করার। কোনো দলের জন্য লেজুড়বৃত্তি না করার।
সংগৃহিত