ষ্টাফ রিপোর্টার:
বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে তিনটি বড় গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনীতির বাঁক বদল ঘটেছে, তার সবগুলোতে দৃশ্যত লাভবান হয়েছে বিএনপি। এই তিনটি ঘটনা ঘটেছে ১৯৭৫ সাল, ১৯৯০ সাল এবং ২০২৪ সালে।
এসব গণঅভ্যুত্থানের একটির মাধ্যমে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছেন, আরেকটি গণঅভ্যুত্থানের পরে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে এবং আরেকটির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
বিএনপি কেন এবং কীভাবে এসব গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে এই লেখার মাধ্যমে সেদিকে ফিরে তাকানো হয়েছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সাঈদ ইফতেখার বলছেন, দুটো গণঅভ্যুত্থানের পরে ‘রাজনৈতিক শূন্যতার’ সুবিধা পেয়েছে বিএনপি ।
প্রতিটি ক্ষেত্রে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগ অত্যন্ত নেতিবাচক হিসেবে জনগণের কাছে প্রতিভাত হয়েছে। সে সুযোগ বিএনপি পেয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, জন-বিদ্রোহ বা জনরোষের ফলে যে সরকার পরিবর্তন হয়েছে, সেটার রাজনৈতিক ফসল বিএনপি ঘরে তুলেছে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার আগে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে অনেকের মনে মারাত্মক অসন্তোষ ছিল।
একদলীয় শাসন ব্যবস্থা, যেটি ‘বাকশাল’ হিসেবে পরিচিত, প্রবর্তনের মাধ্যমে মুজিব-বিরোধী মনোভাব প্রবল হয়ে ওঠে।
“বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ তখন অত্যন্ত নেতিবাচক হিসেবে প্রতিভাত হয়েছিল,” বলছিলেন আমেরিকান পাবলিক ইউনিভার্সিটি সিস্টেম-এর শিক্ষক সাঈদ ইফতেখার আহমেদ।
শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর তৎকালীন বাংলাদেশে পরিষ্কার রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। সেটি পূরণ করার জন্য ‘বিশ্বাসযোগ্য ও জনপ্রিয়’ কোন দল ছিলনা। যেসব রাজনৈতিক দল ছিল, তাদের জনভিত্তি ততটা শক্ত ছিল না।
হত্যাকান্ডের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতাচ্যুত হবার পরে বিএনপি নামক কোন রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব ছিলনা। তখন ক্ষমতায় এসেছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ, যিনি আওয়ামী লীগেরই নেতা ছিলেন।
তবে সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে জিয়াউর রহমান সেনানিবাসের বাইরেও অনেকের কাছে পরিচিত ছিলেন।
১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে বিদ্রোহ হয়। খালেদ মোশাররফের এই অভ্যুত্থানকে ভারতীয় আধিপত্যবাদের একটি ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করে মুজিব-বিরোধীরা। ভারতীয় চক্রান্তের গুজব ঢাকায় ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে মানুষের মনে দুঃশ্চিন্তা এবং সন্দেহ দেখা দেয়।
সাতই নভেম্বর দেশের বিভিন্ন সেনা ছাউনি থেকে সৈন্যরা ঢাকায় এসে পৌঁছায় এবং তাদের সাথে স্বতঃ:স্ফূর্তভাবে হাজার হাজার জনতা যোগ দেয়।
এই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছিল তৎকালীন সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও জাসদ নেতা কর্নেল আবু তাহের। প্রধানত তার পরিকল্পনায় জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা এই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয়।
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলছেন, তখন অনেকের ধারণা হয়েছিল যে আওয়ামী লীগ হয়তো ভারতের সহায়তা নিয়ে আবার ফিরে আসতে পারে। সেই আশঙ্কা কিংবা প্রেক্ষাপট থেকে ৭ই নভেম্বর কর্নেল আবু তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহী-জনতা বিদ্রোহ করে এবং জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে।
ক্যান্টনমেন্টে আবু তাহেরের নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকলেও বাইরে সিপাহী-জনতার মিছিল এবং বিক্ষোভ সকাল দশটার আগেই জাসদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
“সিপাহী-জনতা জিয়া এবং মোশতাকের নামে শ্লোগান দিয়ে ঢাকা শহরকে কাঁপিয়ে তোলে। সেদিন রাজধানীতে সিপাহী-জনতার বিপ্লব ঘটে এবং ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত ভারত এবং আওয়ামী বিরোধী মনোভাবেরই বহি:প্রকাশ দেখা হয়,” এমন বর্ণনা দিয়েছেন মওদুদ আহমদ তার ‘চলমান ইতিহাস’ বইতে।
এরপর বন্দীদশা থেকে জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন। পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করেন, ৭ই নভেম্বর বিদ্রোহ না হলে জিয়াউর রহমান রাজনীতিতে কতটা আসতেন কিংবা আসলেও কতটা সফল হতেন সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
৭ই নভেম্বরের পর থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালিত হতে জিয়াউর রহমানের ইশারায়।
কিন্তু জিয়াউর রহমান মুক্ত হবার পর পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নেয়।
যে জিয়াউর রহমানকে পাশে পাবার আশায় ছিলেন কর্নেল তাহের, সে জিয়াউর রহমান মুক্ত হয়ে ভিন্ন ইংগিত দিলেন।
দৃশ্যপটের সামনে চলে আসেন জিয়াউর রহমান এবং আড়ালে যেতে থাকেন কর্নেল তাহের। খন্দকার মোশতাক ক্ষমতাচ্যুত হবার পরে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়েছিলেন বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম।
তিনি প্রেসিডেন্ট থাকলেও ক্ষমতা পরিচালিত হতো ক্যান্টনমেন্ট থেকে জিয়াউর রহমানের নির্দেশনায়।
১৯৭৬ সালে জুলাই মাসে কর্নেল তাহেরসহ ১৭ জনকে সামরিক আদালতে গোপন বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল। বিচারের কয়েকদিন পরেই কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল।
১৯৭৬ সালের নভেম্বর মাসে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ থেকে সরে যান আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। তখন জিয়াউর রহমানের হাতে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব দেয়া হয়।
এর পাঁচ মাসের মাথায়, অর্থাৎ ১৯৭৭ সালের এপ্রিল মাসে আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব জিয়াউর রহমানের কাছে দিয়ে পদত্যাগ করেন।
রাষ্ট্রপতি হবার দেড় বছরের মধ্যে রাজনৈতিক দল গঠন করেন জিয়াউর রহমান।
“এসময় জিয়াউর রহমান যখন রাজনৈতিক দল গঠন করেন, সেটা তৎকালীন বাংলাদেশে অনেকের কাছে ইতিবাচক মনে হয়েছিল,” বলেন সাঈদ ইফতেখার আহমদ।
মহিউদ্দিন আহমদের ভাষ্য হচ্ছে, “সময়টাকে বিএনপি তাদের পক্ষে নিতে পেরেছিল, আওয়ামী লীগের বিরোধিতার মাধ্যমে। জিয়াউর রহমান পরিস্থিতি সামাল দিয়ে নিজের পক্ষে নিতে পেরেছিলেন”।
১৯৮০’র দশকে তৎকালীন সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদ ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আন্দোলন করে। তাদের সাথে অন্যান্য রাজনৈতিক দলও ছিল।
কিন্তু দেখা গেল, এরশাদের পতনের পরে ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে যখন প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তখন ক্ষমতায় আসে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নেবার কারণে জনগণের মধ্যে তাদের নিয়ে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়।
তখন এরশাদ-বিরোধী বড় রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছিল যে স্বৈরাচার সরকারের আমলে কোন নির্বাচনে তারা অংশ নেবে না। কিন্তু সবাইকে হতবাক করে দিয়ে আওয়ামী লীগ ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল।
নির্বাচনে অংশ নেবার ব্যাপারে এইচএম এরশাদ সরকারের সাথে তাদের একটি সমঝোতা হয়েছিল বলে জানা যায়।
তখন এরশাদ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন মওদুদ আহমদ, যিনি পরবর্তীতে বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন। মি. আহমদ ২০২১ সালে মারা যান।
মি. আহমেদের লেখা ‘চলমান ইতিহাস, জীবনের কিছু সময় কিছু কথা ১৯৮৩-১৯৯০’ বইতে এ বিষয়টি উঠে এসছে।
তিনি লিখেছেন, “সরকারের সাথে এক গভীর সমঝোতার পর আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং নির্বাচন কমিশনে মনোনয়নপত্র দাখিলের সময়সীমার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে তারা তাদের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে।”
সাঈদ ইফতেখার আহমেদের বিশ্লেষণ হচ্ছে, বিএনপি তখন একটা ধারণা তৈরি করতে পেরেছিল যে আওয়ামী লীগ যদি ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশ না নিত তাহলে এরশাদের পতন আরো আগেই ঘটানো সম্ভব হতো।
“এ বিষয়টি বিএনপিকে রাজনৈতিক সুবিধা দিয়েছিল এরশাদের পতনের পর। এর ফলে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে বিএনপি ক্ষমতায় আসে,” বলেন সাঈদ ইফতেখার আহমেদ।
মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, একদিকে এরশাদের সাথে সমঝোতা করে আওয়ামী লীগ ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েছে, অন্যদিকে জেনারেল এরশাদ বিএনপিকে ভাঙার জন্য চেষ্টা করেছেন এবং বিএনপি থেকে একটি অংশকে বের করে এনেছিলেন।
“খালেদা জিয়া নেতা হয়েছিলেন এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। তিনি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী হিসেবে নেতা হন নাই। জিয়ার রহমানের স্ত্রী হিসেবে তিনি দলে এসেছিলেন, কিন্তু নেতা হয়েছিলেন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এই ফসলটা তিনি ঘরে তুলেছিলেন ১৯৯১ সালে,” বলেন মহিউদ্দিন আহমদ।
২০২৪ সালের ৫ই অগাস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাবার পরে যে দুটো রাজনৈতিক দল এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে লাভবান হয়েছে তারা হচ্ছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী।
শেখ হাসিনা পালিয়ে যাবার পরে বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠ স্বয়ংক্রিয়ভাবে আওয়ামী লীগ বিরোধীদের দখলে চলে গেছে।
শেখ হাসিনার শাসনামলে পালিয়ে বেড়ানো কিংবা মামলায় জর্জরিত থাকা বিএনপি নেতারা এখন আগে আওয়ামী লীগের নেতাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হচ্ছে।
৫ই অগাস্টের পরে বেশ দ্রুততার সাথে বিএনপি নেতা খালেদা জিয়াকে মুক্তির আদেশে স্বাক্ষর করের রাষ্ট্রপতি। এরপর বিএনপির বেশ কিছু সিনিয়র নেতা জেল থেকে দ্রুত ছাড়া পান। অনেকের বিরুদ্ধে কিছু মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন।
লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপি নেতা তারেক রহমানের বক্তব্য বিবৃতি শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশে গণমাধ্যমে প্রচার করা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে সংবাদপত্র এবং টেলিভিশনে তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারিত হচ্ছে।
মাঠ পর্যায়ে বিএনপি নেতা-কর্মীদের এখন আর পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে না। এসব কিছু বিএনপিকে তাৎক্ষনিকভাবে রাজনৈতিক সুবিধা দিয়েছে।
গত সাড়ে ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের শাসনামলকে ‘ফ্যাসিবাদের’ তুলনা করেছে বিএনপি। ৫ই অগাস্ট শেখ হাসিনার পতন ও ভারতে পালিয়ে যাবার পরে বিএনপির দেয়া ‘ফ্যাসিবাদ’ তকমা অনেকেই ব্যবহার করছে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে।
“এখনকার বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ জনগণের কাছে অত্যন্ত নেতিবাচক হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে, ” বলেন সাঈদ ইফতেখার আহমেদ।
মি. আহমেদ বলেন, ১৯৭৫ সাল এবং ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ নেতিবাচক হিসেবে উপস্থিতি হয়েছে জনগণের সামনে। এর রাজনৈতিক সুবিধা খুব স্বাভাবিকভাবে আওয়ামী লীগ বিরোধীদের হাতে চলে গেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে মানুষ আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে বরাবর বিএনপিকেই দেখেছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের বাইরে যদি আরেকটি কার্যকরী শক্তি থাকতো তাহলে বিএনপি হয়তো বা এই সুবিধা পেতো না।
“বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের সাথে কোন ফারাক নেই। তাদের মধ্যে অমিল আছে, আবার অনেক মিলও আছে,” বলছিলেন মহিউদ্দিন আহমদ।
তবে বিএনপিকে চ্যালেঞ্জ করার মতো নতুন কোন শক্তি আবির্ভূত হলে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে সেটি এখনই বলা মুশকিল।